হাফডজন ‘স্কুপ’ / Sixer!!!

আমরা যারা ‘রাইজ অফ ভয়েসেস’ চালাই এবং কেন্দ্র ও রাজ্য দুই শাসক পোষ্য মিডিয়ার চিতা জ্বালাই তারা ঘটনাচক্রে সবাই জেনারেশন ‘এক্স’ ও শুরুর দিকের জেনারেশন’ওয়াই’ যাদের আদুরে নাম মিলেনিয়ালস! খুব স্বাভাবিক কারণেই আমাদেরকে বড় হতে হয়েছে ‘অমিতাচ্চন’ আর ‘ডিস্কো মিঠুন’ এর সিনেমা দেখে, যার গপ্পো গুলো ছিল মোটামুটি এক। একটা গরীব হিরো, একটা বড়লোক হিরোইন, একটা হেব্বি পয়সাওলা ভিলেন আর তার চারপাশে ঘুরে ঘুরে শরীর কাঁপিয়ে হিরোকে ইশারা করে নেচে বেড়ানো এক ভ্যাম্প যার চরিত্রে থাকতেন ‘হেলেন’ বা ‘হেলেন’টাইপ কেউ। মাঝেমধ্যে অবশ্য সেই ‘ভ্যাম্প’ গরীব হিরোর হিরোইনও হয়েছে এবং হেলেনের জায়গায় পারভিন ‘ববি’রা এসেছে, এটুকুই যা ব্যতিক্রম বা বৈচিত্র। বাকি সিনেমার গল্পে প্রায় কিছুই বদলাতো না। আর সেই সিনেমা গুলোই আমাদেরকে গিলে খেতে খেতে বড় হতে হয়েছে এবং অপেক্ষা করতে হয়েছে ক-ক-ক-কিরণ বলে চিৎকার করে ওঠা শাহরুখের বা ‘পাপা ক্যাহতে হ্যায়’ এর চচকোলেট বয় আমিরের আসা পর্যন্ত। এখনকার ‘ওটিটি’ সর্বস্ব ‘জেনারেশান আলফা’ বা জেনারেশন জি আমাদের সেই বোরিং এন্টারটেইমেন্ট বুকে নিয়ে বছরের পর বছর অপেক্ষার দিনগুলোর কথা কল্পনাও করতে পারবে না। এখনকার ছক ভাঙ্গা টানটান থ্রিলার-সাসপেন্স-যৌনতা ভরা সিনেমা বা সিরিজের ‘বিঞ্জ ওয়াচ’ যে আমাদের কপালে জুটবে সে সময় আমরা কেউ কল্পনাও করতে পারি নি। এমনকি আমাদের বেশিরভাগের বাড়িতে সেসময় টিভিও ছিল না। মোবাইল বলে যে কিছু আসতে পারে সেরকম কোন ধারনাই ছিল না আমাদের। তখন সিনেমা দেখা বলতে গেলে হয় সিনেমা হলে ছাড়পোকার কামড় খেতে খেতে এবং মাঝেমধ্যে ভিসিআর ভাড়া করে পাড়ার ক্লাবে বা বাড়িতে সবাই মিলে গাদাগাদি করে বসে ‘রিস্তে মে তো হাম তুমহারে বাপ লাগতে হ্যায়’, ‘আই অ্যাম এ ডিস্কো ড্যান্সার’, ‘গুলশন মে গুল খিলতে হ্যায়’, ‘জাওয়ানি জানে মন’ ইত্যাদি করতে হয়েছে।
কিন্তু সেকু-মাকু গুলো যাই বলুক, ওপরওলা আছেই! তিনি সবাইকে সবকিছু দেন না। কিছু দিলেই সঙ্গে সঙ্গে কিছু নিয়ে নেন। মাল’টা হেব্বি হিসেবি। কেন বলছি একথা? কারণ আমরা তথাকতজিত মান্ধাতার আমলে জন্মানো আজকের ‘আঙ্কেল -আন্টি’রা অমিতাচ্চন বা ডিস্কো মিঠুনের ‘ধর তক্তা মার পেড়েক’ সিনেমা দেখে বড় হলেও যেটা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি সেটা হলো আমরা কিন্তু সে সময় ‘খবর’ বলে একটা জিনিষের স্বাদ পেয়েছিলাম যা কম্প্যুটার-মোবাইল-ইন্টারনেটের যুগে ২৪X৭ মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়া আগ্রাসনের মধ্যে বড় হতে থাকা জেনারেশন জি বা আলফারা ভাবতেও পারবে না। আমরা দেখেছিলাম অমিতাভ চৌধুরী, গৌরকিশোর ঘোষদের সাংবাদিকতা যারা বুনো মোষের মত ‘ইন্ডিয়া ওয়ান্টস টু নো’ বলে বুম ক্যামেরার সামনে চিল্লে চিল্লে শাসকের পদলেহন করতেন না বা ভগবান ছাড়া কাউকে ভয় না পেয়ে বাঙালীকে এগিয়ে রাখতে ও এগিয়ে থাকতে সাহায্য করবার নামে ‘প্রাক্তন’ মাননীয়’কে বাজারি ব্র্যান্ড বানাতেন না অথবা বর্তমান মাননীয়ার মধ্যে ‘লেনিন’ খোঁজার চেষ্টা করতেন না। আমাদের ছোটবেলার দিনগুলোতে ভোরবেলায় বারান্দায় এসে পড়া সুতলি বাঁধা খবরের কাগজের মধ্যে যে খবর গুলো থাকতো বা সকাল সাড়ে সাতটার রেডিওতে কলকাতা ‘ক’ স্টেশন থেকে অথবা একটু বড় হওয়ার পর বাড়িতে টিভি এসে যাওয়ায় সন্ধ্যেবেলা কলকাতা দূরদর্শন থেকে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, ছন্দা সেন এবং পরবর্তীতে তরুণ চক্রবর্ত্তীরা যে খবর গুলো পড়তেন তার সামনে আজকের ব্রেকিং নিউজের নামে ঘন্টায় ঘন্টায় যা পরিবেশন করা হয় তা নিতান্তই নাটুকে ও মোটা দাগের এবং অনেকটাই প্রেডিক্টেবল! এই যেমন এবছর সরস্বতী পুজো নিয়ে যে বাংলায় একটা গন্ডগোল কাজিয়া হবে যুযুধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে এবং বঙ্গ সংবাদ মাধ্যমও যে সেটা নিয়ে বেশ নাচানাচি করবে এটা আমরা অনেকেই আন্দাজ করেছিলাম। কারণ ট্রেলারটা কার্তিক পুজোয় দেখা হয়ে গেছে। আবার ধরুন যারা ঘুস খেয়ে অযোগ্যদের স্কুলে স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ করবার সুপারিশ করছে তারা কিভাবে ‘মা সরস্বতীর অপমান বরদাস্ত করবো না’ বলে বিধানসভার অলিন্দে হুঙ্কার ছাড়ছে এই সঙ্গত প্রশ্নটাও যে বঙ্গ মিডিয়ার সেলিব্রিটি সাংবাদিকরা নেতাদেরকে করতে ভুলে যাবে এটাও আমাদের সবার জানা। এমনকি আগামী রাম নবমীর দিন ও তার আগে পরে যে ফের একবার বঙ্গ রাজনীতির যুযুধান দুইপক্ষ হিন্দু-মুসলমান কে লড়িয়ে দিতে চাইবে এবং সেইসব সাম্প্রদায়িক দাপাদাপি কভার করতে বঙ্গ মিডিয়ার বুম ক্যামেরাও যে রেডি হয়ে আছে সেটাও কারও অজানা নয় এবং এটা হবেও। বিগত প্রায় প্রতি বছরই এমনটা হয়ে আসছে। কাজেই এবছর না হওয়ার কোন কারণ নেই। ফের হবে । আমরা দেখবো। ছকভাঙ্গা ‘থ্রিল’ নেই তো কি হয়েছে! প্রেডিক্টেবল হলোই বা! ধর্মীয় সুড়সুড়ি তো আছে। আর জনমানস তাতেই মাত! রাজনৈতিক ভাষ্য নয়, এই ধর্মীয় উন্মত্ততাই এখনকার বঙ্গ পলিটিক্সের ও মিডিয়ার খবরের ইউএসপি!
অথচ আপনি জানলে অবাক হবেন বঙ্গ মিডিয়া চাইলেই কিন্তু এই ভীষণ প্রেডিক্টেবল ধর্মের সুড়সুড়ি সরিয়ে ব্রেকিং নিউজে ছকভাঙ্গা থ্রিল আনতে পারতো। কিন্তু করে নি। কারণ এই ভীষণ প্রেডিক্টেবল পলিটিক্যাল ডিসকোর্সের পরিবেশক হলো এরা। এরজন্যেই এনারা পয়সা পান। তাই যে খবর আমাদের মতো অনাম্নী স্বতন্ত্র মিডিয়া পোর্টালের কাছে থাকে সে খবর এদের কাছে ছিল না এটা ভাববার মত বোকা আমরা নই। অবশ্যই এদের কাছে ছিল এবং এরা জেনেবুঝেই তা চেপে গেছে।
তা কি সেই খবর?
আসলে আর জি কর কান্ডে তদন্তের নামে প্রহসনের পর ‘সেটিং’ তত্ত্ব জনমানসে ক্রমশঃ গতি পাচ্ছে। ফলে প্রধান বিরোধী দল বিজেপি ক্রমশ পায়ের তলায় জমি হারাচ্ছে। মানিক-কেষ্ট-বালু-বাকিবুর -অর্পিতা-কালীঘাটের কাকু, প্রায় সবাই একে একে ‘সিবিআই-ইডি’র হাত থেকে জামিন পাচ্ছে। ঠিক যেমনটা অতীতে পেয়েছে মদন-কুণাল-সুদীপ-টুম্পাই-জলশোভন-মুকুল-ববি’রা ! বাকি আছে শাহজাহান আর পার্থ। আগামী দিনে তারাও জামিন পাবে। অভিষেক ব্যানার্জ্জীর নাম তো কয়লা পাচার কান্ডে সিবিআই এর সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিটে গত দু বছর ধরে প্রায় রোজই উঠছে! কেন্দ্র ও রাজ্য দু শাসকদলের ‘সেটিং’ পলিসি ইডি-সিবিআই কে হাসির খোরাক বানিয়ে ফেলেছে। মানুষ বুঝে গেছে কাঁথির শান্তিকুঞ্জের ছাদে ফাটানো ক্যাপ -কালিপটকা’কে ‘ধামাকা’ নাম দিয়ে বিক্রি করা হয়েছিল। কোন ধামাকা হয়ও নি, আগামী দিনে হবেও না। আর এসব দেখেও মূলস্রোতের সংবাদ মাধ্যম গুলো চুপ থাকবে। কেন ধামাকা হলো না তা নিয়ে শান্তিকুঞ্জের বাসিন্দাকে সংবাদ মাধ্যমের তরফে প্রশ্ন ‘না’ করাটাও এই চেপে দেওয়া চিত্রনাট্যের একটা পার্ট। কিন্তু এসব করেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। মানুষ ‘সেটিং’ তত্ত্বে সিলমোহর দিয়ে ফেলছে। অবস্থা এতটাই গুরুতর যে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতকে তার বঙ্গ কর্মসূচির দিনক্ষণ বেনজিরভাবে বাড়াতে হয়েছে। আর তাই ‘সেটিং’ থেকে মানুষের নজর ঘোরাতে হবে। তাই হাতে উঠে এসেছে ধর্মীয় তাস। বাংলাদেশ নিয়ে কিছুদিন দাপাদাপি করে খুব একটা আশাপ্রদ লাভ হয় নি। কারণ কেন্দ্রের বিজেপি সরকার সমানে বাংলাদেশে টন টন বস্তা-বস্তা চাল -আনাজ রপ্তানি করে গেছে। মোদিজী বা কেন্দ্র সরকারের তরফে সেরকম আক্রমণাত্মক কোন বিবৃতি আসে নি। আর তাই অধিকারী বাড়ির ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসে টার্গেট করেছিল কার্তিক পুজো ও সরস্বতী পুজোকে। এরপর আগামী টার্গেট রাম নবমী। আর হ্যাঁ, আগামী কয়েক মাসে যদি দেখেন, রাজ্যে সাম্প্রদায়িক বাতাসের রমরমা, তাহলে অবাক হবেন না। সুচতুর পরিকল্পনা করেই তা বওয়ানো হচ্ছে। গতকাল বিধানসভার উত্তপ্ত সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের মাধ্যমে যার ‘অ’শুভ সূচনা হয়েছে।
কিন্তু এই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়াবার ব্লু প্রিন্ট কারা, কবে, কোথায় বসে কিভাবে করলো তারই কিছু হদিস দিতে চাই আমরা যা বঙ্গীয় সংবাদ মাধ্যম জেনেবুঝে চেপে গেছে। অথচ এগুলোই আসল খবর এবং সেই অর্থে যথেষ্ট থ্রিলিং। মনোরঞ্জক ব্রেকিং নিউজ হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে এগুলোর মধ্যে।। আপনারা চাইলে এখনও আমাদের থেকে স্কুপ নিয়ে এগুলোকে খবরের আকারে পরিবেশন করতে পারেন। শুধু আপানদেরকে এই নিম্ন উল্লেখিত ছয়টি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে।
১. বিধায়ক হুমায়ুন কবিরের যে আইফোন চুরি গেছে বিধানসভা থেকে তা কোথায় ? সেই ফোনের মেমোরিতে কিধরণের সাম্প্রদায়িক বিপজ্জনক মালমশলা পাওয়া যাবে বলে ঠিক করা হয়েছে?
২. শিলিগুড়ির অদূরে দিল্লির শাসকদলের কোন অবাঙালি সাংসদ কাম ডাক্তারবাবু তৃনমূল নেতাদের সাথে বৈঠক করে গেছেন? সেই বৈঠকের এজেন্ডা কি ছিল ? নয়ডার কোন হাসপাতাল চালান সেই সাংসদ ডাক্তারবাবু?
৩. বাংলার শাসক দলের ও দিল্লির শাসক দলের কোন কোন নেতারা সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন?
৪. যে মিডিয়া করেসপন্ডেন্ট চ্যানেলে চ্যানেলে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা প্রমোশনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন, তিনি কে?
৫. গতকাল রাজ্য বিধানসভায় যে পাগড়ি কর্মসূচি ছিল, তার ব্লু প্রিন্ট কলকাতার কোন অফিসে বসে ঠিক হয়েছিল?
৬. রাম নবমী ও লালয়াত আল কদর এই বছরের কোন দিন হতে চলেছে এবং সেই দিন কেন রাজ্য রাজনীতিতে গুরুত্বপুর্ণ হয়ে উঠতে পারে ?
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুরা মাত্র এই ছয়টি প্রশ্নের উত্তর খুঁজলেই বাংলার মানুষের সামনে আপনারা নিজেদের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও মেরামত করতে পারবেন। পারবেন নতুন প্রজন্মের যারা এখন বড় হচ্ছে সেই জেনারেশন জেড বা আলফা’র সামনে খবর কাকে বলে তার আসল নমুনা পেশ করতে। কিন্তু আপনারা তা চান কি ? এটাই লাখ টাকার প্রশ্ন।
উত্তর চায় জেনারেশন এক্স, ওয়াই, জেড, আলফারা। উত্তর চায় সব গণতন্ত্রপ্রেমী সংবাদমাধ্যমকে চতুর্থ স্তম্ভ বানানো মানুষ। উত্তর চায় বাংলা।
ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস
Comments are closed.