সঙ্কটে প্রতিবাদ / Divided by Faith, United by Silence

মণিপুরের আগুন এখনও নিভে যায়নি। জাতিগত সংঘর্ষে বিধ্বস্ত দেশের একটি রাজ্যের গৃহহীন মানুষ, ধর্ষণ ও সহিংসতার শিকার নারীরা, আর নিস্পৃহভাবে তাকিয়ে থাকা দেশের নাগরিক সমাজ—এই বাস্তবতা আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ করে। কিন্তু মণিপুরই কি একমাত্র উদাহরণ? আমাদেরই রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে, সম্প্রতি বেলডাঙ্গায় ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার ঘটনা আমাদের আরও গভীর অসহিষ্ণুতা আর উদাসীনতার চিত্র তুলে ধরে।

ঘটনার সূত্রপাত মুর্শিদাবাদের বেলডাঙ্গায় কার্তিক পুজোর একটি মণ্ডপে। আলোকসজ্জায় বড় বড় করে লেখা হয়েছিল “Mother F***er Al**h”, যা এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ভাবাবেগে চরম আঘাত হানে। প্রত্যাশিতভাবেই পরিস্থিতি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। শুরু হয় তীব্র গণ্ডগোল, যার ফলে পুরো মুর্শিদাবাদ জেলায় টানা ছয় দিন ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখতে বাধ্য হয় প্রশাসন। অথচ, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কলকাতার রাজপথে কোনো মিছিল দেখা যায়নি। কোনো মানবাধিকার সংগঠন বা নাগরিক সমাজ এই ইস্যুতে সরব হয়নি।

প্রশ্ন হলো, বেলডাঙ্গার এই ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার ঘটনায় কেন সেভাবে প্রতিবাদ হয়নি? একটি সমাজ যখন এক পক্ষের ধর্মীয় অধিকার লঙ্ঘন করে, তখন তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা কি সকলের দায়িত্ব নয়? অথচ আমরা দেখি, সেই দায়িত্ব পালন তো দূরের কথা, বরং পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলার চেষ্টা হয়েছে। সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া যেমন অন্যায়, তেমনি প্রতিশোধ নিতে সহিংসতার পথ বেছে নেওয়াও সমানভাবে নিন্দনীয়। কিন্তু এই ঘটনাগুলিকে জাতীয় কিংবা মানবিক ইস্যু হিসেবে তুলে ধরার পরিবর্তে আমরা কেবলমাত্র রাজনৈতিক মেরুকরণের হাতিয়ার বানাই।

ঠিক একইভাবে মণিপুরে যখন আগুন জ্বলছে, তখনও জাতীয় রাজনীতির মূলধারায় সেই ইস্যুটি “উত্তর-পূর্বের সমস্যা” বলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। বেলডাঙ্গা বা মণিপুর, দু’টি ঘটনাই আসলে আমাদের সমাজের গভীর বিভাজন আর নির্বাচিত প্রতিবাদের সংস্কৃতির দিকে আঙুল তোলে। আমরা প্রতিবাদ করি তখনই, যখন সেটা আমাদের পক্ষে সুবিধাজনক হয়। সাম্প্রতিক উদাহরন তিলোত্তমা হত্যা রহস্য। আমরা ফিলিস্তিন বা বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে সরব হই, কারণ সেগুলি আমাদের মানবিক বোধের সঙ্গে “সুসজ্জিত”। এতে ভোট সমীকরণ এদিক ওদিক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু মণিপুর বা বেলডাঙ্গার মতো ঘটনা আমাদের পছন্দের তালিকায় আসে না।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, “দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া”। আমরা নিজের দেশের মাটিতে ঘটে যাওয়া বিভীষিকাগুলি নিয়ে অন্ধ। আমরা আমাদের প্রতিবাদের মানদণ্ড নিজের পছন্দ-অপছন্দ দিয়ে সাজাই। আমরা ভুলে যাই, একটি অঞ্চল বা রাজ্য পুড়ে গেলে সাথে দেশও পুড়ে যায়, সাথে পোড়ে মানবিকতা, দায়িত্ববোধ। একটি অঞ্চলে ধর্মীয় সহিংসতা ঘটলে তা আসলে আমাদের মানবিকতার মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়।

মণিপুর আর বেলডাঙ্গা, এই দুই জায়গার ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় যে সংকীর্ণ রাজনীতি আর নির্বাচিত প্রতিবাদের কারণে আমাদের সমাজ কেমন বিপজ্জনক পথে এগোচ্ছে। প্রতিবাদ হওয়া উচিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে, ব্যক্তি বা সম্প্রদায় দেখে নয়। আমরা যদি আজও এই দৃষ্টিভঙ্গি না বদলাই, তবে আমরা শুধু আমাদের নৈতিক অবস্থানই হারাব না, বরং আমাদের ভবিষ্যৎও আরও অন্ধকারে ডুবে যাবে।