উইঙ্কেল টুইঙ্কেল / Rekindling the Spirit of Collective Action

শক্তিশালী গণসংগঠন বামপন্থী রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইতিহাস সাক্ষী, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, যুব ও নারী—সমাজের প্রতিটি স্তরে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তোলার মাধ্যমে বামপন্থীরা এই বাংলায় শোষিত শ্রেণির মুখপাত্র হয়ে উঠেছিল। গণসংগঠনগুলোর লক্ষ্য ছিল জনগণের সমস্যাগুলি রাষ্ট্রের সামনে তুলে ধরা, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই চালানো। এই সংগঠনগুলোর ঐক্যই একসময় বামপন্থী আন্দোলনকে শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিল। কিন্তু আজ সেই গণসংগঠনগুলির অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি দেখলে স্পষ্ট যে, আদর্শের জায়গা দখল করেছে গোষ্ঠীবাজি, আর ঐক্যের পরিবর্তে দানা বেঁধেছে নেতৃত্বের জন্য অন্তর্দ্বন্দ্ব।

একটি গণসংগঠন যে কোনো রাজনৈতিক দলের শক্তির উৎস। বামপন্থার ক্ষেত্রেও তা আলাদা নয়। পশ্চিমবঙ্গে একসময় এই সংগঠনগুলির মাধ্যমে বামপন্থীরা জনগণের আস্থা অর্জন করেছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংগঠনগুলির মূল লক্ষ্য থেকে সরে গিয়ে নেতৃত্বের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং ক্ষমতা ধরে রাখার লড়াই অনেকক্ষেত্রেই সংগঠনের ভেতরকার পরিবেশ বিষাক্ত করে তুলেছে। আদর্শগত অবস্থান ছেড়ে গোষ্ঠীবাজি এবং ব্যক্তি কেন্দ্রিকতা যখন একটি সংগঠনের চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়ায়, তখন তার কার্যকারিতা হারানো সময়ের অপেক্ষা। আর তাই হয়েছে গত কুড়ি পঁচিশ বছরে।

গণসংগঠনের অভ্যন্তরীণ এই সংকট শুধু সংগঠনের ঐক্যে নয়, বৃহত্তর বামপন্থী রাজনীতির ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। একসময় যে সংগঠনগুলো জনতার দাবিগুলি প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করত, আজ তারা নিজেদের মধ্যে বিভাজিত। ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং নেতৃত্ব ধরে রাখার মানসিকতা সংগঠনগুলোর মধ্যে হতাশা এবং অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।

বর্তমান সময়ে গণসংগঠনগুলির অভ্যন্তরে সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটি হলো গোষ্ঠীবাজি। নেতৃত্বের জন্য লড়াই, ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা, এবং একে অপরকে অবদমন করার প্রবণতা ক্রমশ সংগঠনের ঐক্যকে দুর্বল করে দিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন ঘটনা সামনে এসেছে যেখানে একটি গণসংগঠনের কর্মী অন্য সংগঠনের কর্মসূচিতে অংশ নিলে তাকে ভর্ৎসনার মুখোমুখি হতে হয়েছে। এটি শুধুমাত্র আদর্শের বিচ্যুতি নয়, বরং গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থী।

এমন পরিস্থিতি সংগঠনের ভেতরের কর্মীদের মধ্যে হতাশা তৈরি করে। একসময় যারা আদর্শের টানে সংগঠনে যোগ দিয়েছিলেন, তারা আজ নিজেদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা এবং নেতৃত্বের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতা সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণকেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত করছে।

গণসংগঠনের এই দুর্বলতা সবচেয়ে প্রকটভাবে ধরা পড়ে ভোটের সময়ে। একদিকে কর্মীদের মধ্যে বিভাজন এবং অসন্তোষ, অন্যদিকে সংগঠনের কার্যকারিতার অভাব, পদ টিকিয়ে রাখতে এলাকাভিত্তিক অসত্য তথ্য সরবরাহ—তিনটি মিলিয়ে নির্বাচনী রাজনীতিতে বামপন্থীদের অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গণসংগঠনের কর্মীদের মাঠপর্যায়ের কাজ অনেক ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই, সাধারণ জনগণও প্রকাশ্যে সংগঠনের এই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দেখে বামপন্থীদের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে।

গণসংগঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। কিন্তু গোষ্ঠীবাজি এবং পুরনো নেতৃত্বদের যেকোনো মূল্যে চেয়ার ধরে রাখার প্রবণতা নতুন প্রজন্মকে সংগঠন থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। তাই আজকের তরুণ সমাজ বামপন্থার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। এটি বামপন্থী রাজনীতির দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্য একটি বিপদসংকেত।

কিন্তু সব শেষ হয়ে যায়নি। এই সংকটের সমাধান সম্ভব, কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন সংগঠনগুলির ভেতরে স্বচ্ছতা এবং নেতৃত্বের ঐক্য। ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সংগঠনগুলিকে তাদের মূল আদর্শ এবং উদ্দেশ্যগুলির দিকে ধাবিত হওয়ার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতা বাড়ানোর সাথে সাথে নতুন প্রজন্মের জন্য জায়গা তৈরি করার কাজ আরো দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করার চেষ্টা করা হলে, একদিন না একদিন কাঙ্খিত ফল মিলবেই।

নেতৃত্বের এই সমস্যাগুলোর সমাধান না হলে, গণসংগঠনের অবক্ষয় বামপন্থী রাজনীতির অস্তিত্বকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাবে। যা বাংলা তথা দেশের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাই আজ প্রয়োজন আত্মসমালোচনা এবং দায়িত্বশীলতা। গণসংগঠনগুলিকে তাদের মূল লক্ষ্য—শোষিত শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা । ব্যাস, এইটুকুই।

আসলে, বামপন্থার সাফল্য গণসংগঠনের শক্তির ওপর নির্ভর করে। ঐক্যের পথে ফিরে আসাই একমাত্র উপায়, এছাড়া আর কোনো পথ নেই। ঠিক যেমন একটি তারা রাতের অন্ধকারে আলো ছড়িয়ে পথ দেখায়, তেমনি গণসংগঠনগুলিকেও নিজেদের আলোকিত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা দরকার। আজকের বাস্তবতা যতোই কঠিন হোক, ভবিষ্যতের প্রতি আস্থা রেখে নতুন প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করতে পারলেই এক নতুন দিনের সূচনা সম্ভব। পুনর্জাগরণের এই আলোই বামপন্থী রাজনীতিকে পুনরায় উজ্জ্বল করতে পারে।

ধন্যবাদান্তে,
হরিনারায়ণ মিত্র