নিরাপত্তা নাকি নিষেধাজ্ঞা / Unmasking Hypocrisy

নারী নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের সমাজে দীর্ঘদিন ধরেই নানা প্রশ্ন উঠছে। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেওয়া পরামর্শ—মেয়েদের নাইট শিফটে কাজ না করার জন্য—তাদের দায়িত্ব এড়ানোর একটি কৌশল হিসেবে ধরা যেতে পারে। এই ধরনের পরামর্শ কীভাবে কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে?

রাজ্য সরকারের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, তারা নিজেদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছে। তারা নারীদের সুরক্ষিত রাখতে ব্যর্থ। ফলে নারীদের ঘরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছে। এটি নারী স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত। তবে এই ঘটনা নতুন কিছু নয়, অতীতে একের পর এক ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনার ধারাবাহিকতায় দেশের নানান প্রান্তের ক্ষমতাসীন সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।

পার্ক স্ট্রিট, কামদুনি, হাঁসখালি থেকে শুরু করে উন্নাও, হাতরস, বিলকিস বানো—এই সমস্ত ঘটনা প্রমাণ করে, আমাদের বিচার ব্যবস্থায় ন্যায়বিচারের অভাব কতটা তীব্র। উন্নাওয়ের ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী ব্যক্তির হাতে এক কিশোরীকে ধর্ষণ করা হলো, আর তার পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা হলো। হাতরসের ঘটনায় এক নিরীহ দলিত মেয়েকে নির্মমভাবে অত্যাচার করা হলো, তারপর তার মরদেহ রাতে পুড়িয়ে দেওয়া হলো যাতে ঘটনা ধামাচাপা পড়ে।

বিলকিস বানোর ঘটনা তো আরও ভয়াবহ। ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গায় তার পরিবারকে হত্যা করা হলো এবং তাকে গণধর্ষণ করা হলো। সেই অপরাধীরা যখন ক্ষমতায় এল, তখন মুক্তি পেল। এই ঘটনা নারীর প্রতি ঘৃণা এবং বিচার ব্যবস্থাকে অপমান করার এক নিকৃষ্ট উদাহরণ।

বাংলায় ধর্ষণের ঘটনা যে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে, তার দায় কে নেবে? প্রতিটি ঘটনা—পার্ক স্ট্রিট, কামদুনি, হাঁসখালি—যেখানে সঠিকভাবে তদন্ত চালানোর বদলে অপরাধীদের আড়াল করা হয়েছে, তা এই সমাজের জন্য এক গভীর লজ্জার বিষয়। সৎ পুলিশ অফিসারদের শাস্তিমূলক বদলি করে দিয়ে অপরাধের ন্যায্য তদন্ত বন্ধ করা হয়েছে। আমরা ভুলিনি, ভুলবোও না।

বিশেষ করে হাঁসখালি ধর্ষণ মামলার পর একজন মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, “শরীর থাকলে যেমন সর্দি-কাশি হয়, তেমন ধর্ষণও হয়,” আমাদের সমাজে নারীদের প্রতি অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এমন মন্তব্য শুধু ধর্ষণকে হালকা করে দেখায় না, বরং তা একটি শক্তিশালী বার্তা দেয় যে, ক্ষমতার আড়ালে অপরাধীরা আড়াল পাবে।

ক্ষমতাসীনদের ভূমিকা এই সমস্ত ঘটনায় প্রশ্নবিদ্ধ। তারা শুধুমাত্র অপরাধীদের রক্ষা করেছে তাই নয়, এমন একটি সামাজিক পরিস্থিতি তৈরি করেছে যেখানে নারীরা ক্রমাগত অরক্ষিত বোধ করছে। বর্তমান নীতিগুলি নারীদের জন্য যে কতটা ক্ষতিকারক, তা এই ঘটনাগুলোই প্রমাণ করে।

কিন্তু, সমাজ যে নীরব নয়, তার প্রমাণ আবারও মিলল। ১৪ ই আগস্ট মধ্যরাতে, বাংলার নারীরা রাস্তায় নেমে ডক্টর তিলোত্তমার ধর্ষক খুনিদের উপযুক্ত শাস্তির দাবি করলেন। সেই রাতে রাস্তাগুলোতে ছিল নারীদের দখল। এটি এক অভূতপূর্ব প্রতিবাদ, যা দেখিয়ে দিল, মেয়েরা শুধুমাত্র ভিকটিম হতে রাজি নয়, তারা যোদ্ধাও।

এই জাগরণ সমাজের অন্য স্তরেও ছড়িয়ে পড়েছে। আজ ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মহামেডানের ফুটবলপাগল জনতা শতবর্ষ প্রাচীন ডার্বি অন্যায়ভাবে বন্ধ করার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এল। তিলোত্তমার সংগ্রাম যেন তাদেরও স্পর্শ করেছে। ফুটবলের প্রতি তাদের ভালোবাসা আজ অন্যায্যতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রূপ নিয়েছে। তিলোত্তমা যেন সকলের আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে, তার নির্মম হত্যা সকলের মধ্যে সাহসের আলো জ্বালিয়েছে।

এই আন্দোলন আমাদের প্রতিনিয়ত শিক্ষা দিচ্ছে যে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই শুধু নারীদের কাজ নয়, এটা পুরো সমাজের দায়িত্ব। তিলোত্তমার সুবিচারের জন্য সংগ্রাম শুধু মেয়েদের নয়, সমাজের সকলের হৃদয়ে পৌঁছে গেছে। দেশব্যাপী সাধারন জনতার এই প্রতিবাদ প্রমাণ করে দেয়, অন্যায়কে মেনে নেওয়া আর হবে না।

আমরা ঘৃণা এবং ক্রোধে নীরব থাকতে পারি না। আমাদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, আমাদের রাতের ঘুম হারিয়ে গেছে। একটি মেয়ের সম্মান কিংবা প্রাণের মূল্য কখনওই কয়েক লক্ষ টাকায় মাপা যায় না, অথবা রাজ্যের সব মেয়েদের নাইট শিফটে কাজ না করার পরামর্শ দিয়েও হবে না। আমরা ন্যায়বিচার চাই—দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। কারণ আমরা ভুলিনি, ভুলবোও না, ভুলতে দেবো না।

ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস