‘বন্যা’রা মানুষের ভিড়ে / Not the Elite’s, But the Toilers’ Brigade

গতকাল, মানে রবিবার, ২০ শে এপ্রিল ২০২৫, বামেদের ব্রিগেড ছিল। আরও গোদা বাংলায় বললে বলতে হয় ‘সিপিএম’এর ব্রিগেড ছিল। আজকের সংসদীয় রাজনীতিতে যদিও বঙ্গ সিপিআই(এম) হলো ‘হেরো’ পার্টি। ‘শূন্য’ বা ৫% ভোটারের পার্টি বলেই রাজনীতির বাজারে এই মুহুর্তে তার ‘মূল্য নির্ধারণ’ করা হয়ে থাকে।

অথচ সেই অকিঞ্চিৎকর পার্টির ব্রিগেড নিয়ে তিন-চারদিন আগে থেকে মানে গত সপ্তাহের মাঝ বরাবর সময় থেকে শাসক দলের সোশ্যাল মিডিয়া স্যাভি ‘জেলখাটা’ মুখপাত্রের একের পর এক ট্যুইট-কটাক্ষ দেখে আমরা কিছুটা হলেও স্তম্ভিত! শুধু তাই নয়, প্রতিটা ট্যুইটেই উনি প্রকারন্তরে আগ বাড়িয়ে মেনে নিচ্ছিলেন যে বামেদের ব্রিগেডে ভিড় হবে। পাশাপাশি নিজের দলের কর্মীদের ‘অভয়বার্তা’ বা স্তোতবাক্য শোনাচ্ছিলেন এই বলে যে ভিড় দেখে ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই, ভিড় মানেই ভোট নয়, সিপিএম যেমন শূন্য ছিল তেমনই শূন্য থাকবে, বামের ভোট ফের রামে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি…. অর্থ্যাৎ ‘সিপিএম’এর ব্রিগেডে যে বিপক্ষকে ঘাবড়ে দেওয়ার মত ভিড় হতে চলেছে তার একটা আন্দাজ পাওয়াই যাচ্ছিল।

আর হলোও তাই। আমাদের ছোটবেলায় একটা কথা চালু ছিল। ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডটা নাকি তৈরিই হয়েছে সারা বছর সেনাবাহিনী প্যারেড করবে বলে আর বছরে একদিন সিপিএম লোক এনে মিটিং করে ভরাবে বলে। গতকাল ছিল সিপিএমের মাঠ ভরতি লোক আনার দিন। আর আমরা দেখলামও তাই। ব্রিগেডের মাঠ জুড়ে দেখা গেলো সিপিএমের লাল ঝান্ডার প্যারেড।

যদিও এদিন সভাটা সিপিআই(এম) বা বামফ্রন্ট ডাকেনি। ডেকেছিল সিপিআই(এম)র কৃষক ও ক্ষেত মজুর সংগঠন, শ্রমিক ইউনিয়ন ও বস্তি উন্নয়ন সমিতি। আপনারা বলবেন ঐ একই হলো! কিন্তু না, গতকালকের ব্রিগেডের চরিত্র ছিল আলাদা। বিগত বিশ বছর ধরে সিপিআই(এম) বা বামফ্রন্টের ডাকে ব্রিগেডে মাঠ ভরিয়ে এসেছে কলকাতা ও শহরতলী দুই ২৪ পরগণার সংগঠিত ধোপদুরস্ত আপাত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত জনতা যাদের হাবেভাবে ঝড়ে পড়তো ‘মাতব্বরি’, দু চোখ চকচক করতো বিরুদ্ধ মতকে তর্কে-স্লোগানে উড়িয়ে দিয়ে জিতে যাওয়ার অহংকারে ও উন্নাসিকতায়। কিন্তু কালকের ব্রিগেড ভরালো গায়ে গতরে খেটে খাওয়া প্রান্তিক গরীব মানুষ যা ছিল একদা বাম তথা সিপিআই(এম) এর ‘কোর ভোটব্যাঙ্ক’। এদের কেউ কল-কারখানার শ্রমিক বা অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন, কেউ ক্ষেত মজুর, কেউ বস্তিবাসী ফুচকাবিক্রেতা-আইসক্রিমওলা অথবা বাজারে আলু-সব্জি-মাছ ইত্যাদি বিক্রি করেন, কেউ আবার পরিযায়ী শ্রমিক যিনি ঈদের ছুটিতে ঘরে ফিরেছিলেন এবং ফের কাজের খোঁজে ভিনরাজ্যে যাওয়ার আগে গতকালকের ব্রিগেডে ঘুরে গেলেন। অবশ্য ঐ প্রখর তীব্র দাবদাহে ধোপদুরস্ত ‘ধান্দাবাজ’ মধ্যবিত্ত শ্রেণী (যে শ্রেণীতে এই প্রতিবেদনের লেখক নিজেও পড়েন) লাল ঝান্ডা হাতে মাঠ ভরাবেন এটা ছিল কষ্ট কল্পনা। তাই আমাদের জানাশোনা অনেকেই ভেবেছিলেন মাঠ ভরবে না। ফাঁকা যাবে। কিন্তু বামেদের শ্রমিক, কৃষক, ক্ষেতমজুর ও বস্তিবাসীদের সংগঠন যে এপ্রিলের প্রখর রোদে ব্রিগেড ভরাতে লক্ষাধিক নন-এলিট প্রান্তিক প্রোলেতারিয়েতের ভিড় সত্যি সত্যি জুটিয়ে ফেলবে সেটা অনেকেই ভাবেন নি। আমরাও না। মাঠে উপস্থিত আমাদের প্রতিনিধিদের ফিডব্যাকও বলছিল এবারের ব্রিগেডের ‘মেজাজ’টা ছিল একটু আলাদা। একরাশ ঘোলাটে চোখ, চোয়াল ভাঙ্গা মুখ আর জোয়াল ভাঙ্গা বুকের মাঠজোরা জমাটি ভিড়। সে তুলনায় অন্যবারের চেয়ে তথাকথিত শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সংখ্যা ছিল বেশ কম। তাই একটা ‘শূন্য’ পার্টির আপাত শিক্ষিত সমর্থকদের মধ্যে সরাসরি ছাব্বিশের নির্বাচনে বিজেপি তৃণমূলকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার মধ্যে যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাজ করে সেটা গতকাল মাঠের ভিড়ে দেখা যায়নি। উলটে মাঠ জুড়ে শোনা গেছে আগামী ছাব্বিশের নির্বাচনে তৃণমূল-বিজেপির উইকেট ফেলে দেওয়ার হুঙ্কার। আপাদমস্তক জড়তাহীন অকুতোভয় মেহনতি প্রান্তিক মানুষের এই ভিড়টাকেই এদ্দিন ধরে হন্যে হয়ে খুঁজছিল আলিমুদ্দিন। আর সেই পরীক্ষায় তারা মোটামুটি পাশ। আর এদের সাথেই রীতিমত ডিস্টিংশন নিয়ে পাশ করলেন অমল হালদার, তুষার ঘোষ, সুখরঞ্জন দে ও অনাদি সাহুরা। পাশ করলেন বঙ্গ সিপিএমের ব্রিগেডিয়ার সেলিমও। গতবছর লোকসভা ভোটের আগে যুবদের দিয়ে ‘ক্যাপ্টেন’ মিনাক্ষীর নেতৃত্বে ব্রিগেড ভরানোর পর এবার ঝাঁকুনি দেওয়া গেলো গরীব খেটে খাওয়াদের নিয়ে তৈরি বাম গণসংগঠন গুলোকেও। ব্রিগেড ভরলো। নেতারা পাশ নম্বর পেলো। কিছুটা অক্সিজেন পেলো সিপিআই(এম)ও। কিন্তু উপস্থিত বাম জনতা কি পেল !

তারা পেলেন এক নতুন ‘শো স্টপার’কে। নাম বন্যা টুডু। তিনি এলেন। দেখলেন। জয় করলেন। মাঠে ময়দানের লড়াই থেকে উঠে আসা, শাসক ঘনিষ্ঠ জমি হাঙ্গরদের গ্রাস থেকে জমি বাঁচানো এক আদিবাসী গেঁয়ো মহিলা কলকাতার বুকে ব্রিগেডের মঞ্চে দাঁড়িয়ে আদিবাসী ও বাংলা ভাষার মিশেলে লাখো মানুষের ভিড়ের সামনে দাঁড়িয়ে যে সাবলীল ভাষণ দিলেন তাকে কুর্নিশ না জানিয়ে উপায় নেই। ছাব্বিশে বাম বিরোধীদের উইকেট ফেলার হুঙ্কার দিলেন বন্যাই। করতালির মধ্যে স্বাগত জানালো মাঠ। ভিক্টোরিয়ার পরীটাও বোধহয় বন্যাদের মত এইসব টুকরো টুকরো ব্যতিক্রমী মুখ ও মুহুর্তের সাক্ষী হবে বলেই এখনও চুপটি করে বসে থাকে, ডানা মেলে উড়ে যায় না।

আলিমুদ্দিন স্ট্রীট কিন্তু বিগত এক দশকে নয় নয় করে বেশ কিছু নতুন মুখ তুলে এনেছে। না, শতরুপ-সৃজন-দিপ্সীতা-ঐশীদের মত শিক্ষিত শহুরে মুখের কথা হচ্ছে না। গ্রাম বাংলার প্রান্তিক মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে এমন মুখের কথা বলছি আমরা। শুরুটা হয়েছিল দেবলীনা হেমব্রমকে দিয়ে। তারপর একে একে মিনাক্ষী মুখার্জ্জী, সোনামণি মুর্মু এবং এবার বন্যা টুডু। সেখানে রাজ্যের শাসক কিন্তু সেই কালীঘাটের পিসি-ভাইপো’তে আটকে। আর মুরলীধর সেন লেনের ফার্স্ট বেঞ্চের তো পুরোটাই পিসি-ভাইপো পার্টির থেকে হাতানো,যার বেশিরভাগই ‘দাগী’। কাঁথির অধিকারিদের কীর্তি কলাপ বা ব্যারাকপুরের অর্জুন সিং এর তান্ডব, ভোটলুটের কিসসা সবারই জানা।

কিন্তু প্রশ্ন একটাই। এইসব দাগীদের দাপাদাপিতে মিনাক্ষী-সোনামণি-বন্যারা কি পারবেন মানুষের মনে দাগ কাটতে। আলিমুদ্দিন কি পারবে ২০ শে এপ্রিলের ব্রিগেডের জেদি-তেজি মেজাজ মানুষের ভিড়ে ছড়িয়ে দিতে! পারবে কি মানুষের সাথে মিশে লাল ঝান্ডা হাতে মানুষের দাবি দাওয়ার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে। নাকি ‘পতাকাবিহীন’ অবিমৃশ্যকারিতা আর নির্বাচনী জোট জটের গেরোয় ফের আটকে যাবে।

মানুষকে শুধু বোঝানো নয়, মানুষকে বুঝতেও শিখুক আলিমুদ্দিন স্ট্রীট। শুধু পরিকল্পিত ঘোষিত কর্মসূচি পালন নয়, রোজকার হাতে গরম ইস্যুতে লাল ঝান্ডা কাঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ুক মানুষকে সাথে নিয়ে। কারণ-

বন্যেরা বনে সুন্দর
বন্যা’রা মানুষের ভিড়ে।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস