মিশন কালীগঞ্জ / Mission Kaliganj

আগামী ১৯শে জুন, দেশের অন্যান্য ৪টি বিধানসভা উপনির্বাচনের সাথে এই বাংলাতেও আছে উপনির্বাচন। তা নদিয়ার কালীগঞ্জে। গত ২রা ফেব্রুয়ারী তৃণমূল বিধায়ক নাসিরুদ্দিন আহমেদের হৃদরোগে প্রয়ানের পর বিধায়ক পদটি শুন্য হয়েছে। তাই এই অকাল নির্বাচন। কিন্তু উপনির্বাচনের আগে কোন দল কোথায় দাঁড়িয়ে, তার তুল্যমূল্য আলোচনার জন্যেই আজকের এই প্রতিবেদন।

কৃষ্ণনগর লোকসভার কালীগঞ্জ আসন বহু রাজনৈতিক উথাল পাথাল দেখেছে। ১৯৫১ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটিতে প্রথম থাবা বসায় আরএসপি। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৭ এই আসন ছিল আরএসপির দখলে। তারপর ১৯৮৭ থেকে ২০০১, কংগ্রেস এই আসন ছিনিয়ে নেয় আরএসপির কাছ থেকে। এরপর আবার উলটপুরাণ, ২০০১ থেকে ২০১১ আবারো কালীগঞ্জ আসনে জয়লাভ করে আরএসপি। ২০১১ থেকে ২০১৬ তৃণমূল কংগ্রেস দখলে রাখলেও, ২০১৬ তে বাম-কংগ্রেস জোট সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী হাসানুজ্জামান শেখ জয়লাভ করেন এই বিধানসভা কেন্দ্রে। কিন্তু কয়েকমাস যেতেই বিজয়ী কংগ্রেস প্রার্থী হাসানুজ্জামান শেখ কংগ্রেস ছেড়ে অভিষেক বন্দোপাধ্যায়ের হাত ধরে যোগ দেন শাসক শিবির তৃণমূল কংগ্রেসে। আর গত ২০২১ এর নির্বাচনে এই কেন্দ্রে জয়ী হন তৃণমূল কংগ্রেসের নাসিরুদ্দিন আহমেদ। তারই মৃত্যুতে এই বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন।

সামনে নির্বাচন, নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বীরা দাঁড়িয়ে সম্মুখ সমরে। তাই কাদের অ্যাডভান্টেজ আর কাদের ডিস্যাটভান্টেজ, তা জেনে নেওয়া যাক। মিডিয়া যতই বলুক লড়াই দ্বিমুখী, কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে এই লড়াই ত্রিমুখী। কেন ত্রিমুখী সেটা তাহলে জেনে নেওয়া যাক।

২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তৃণমূল কংগ্রেসের নাসিরুদ্দিন আহমেদ, বিজেপির অভিজিৎ ঘোষ এবং বাম কংগ্রেস আইএসএফ জোট সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী আবুল কাশেম। সেই নির্বাচনে জয়ী হন তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী এবং উল্লেখযোগ্যভাবে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে বিজেপি, আর গত নির্বাচনের বিজয়ী দল কংগ্রেস ১১.৯৮% ভোট পেয়ে তৃতীয়। পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে, গতবারের বিজয়ী কংগ্রেস প্রার্থীর দলবদল এই অঞ্চলের অকংগ্রেসী জোট সমার্থকরা মেনে নিতে পারেননি, সেক্ষেত্রে এক বৃহৎ অংশের ভোট চলে গিয়েছিল শাসক তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির ঝুলিতে।

কংগ্রেস
২০১৬: ৮৫,১২৫
২০২১: ২৫,০৭৬
গত বিধানসভা থেকে কংগ্রেসের ভোট কমল ৬০,১৪৯। উল্টোদিকে বিজেপির ভোট বাড়ল ৫৪,৩৩৬।

বিজেপি
২০১৬: ১০,৩৭৩
২০২১: ৬৪,৭০৯

আর তৃণমূল কংগ্রেস আগের বারের থেকে নিজেদের আরো বেশি শক্তিশালী করে তুলল এই অঞ্চলে। তারা নিজেদের ঝুলিতে পুড়ল ২৭,৭৯৮ টি ভোট।

তৃণমূল কংগ্রেস
২০১৬: ৮৩,৮৯৮
২০২১: ১,১১,৬৯৬

২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর এই অঞ্চলে আরো দুটি নির্বাচন হয়েছে, একটি ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন এবং ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচন। এই দুই নির্বাচনেই তৃণমূল কংগ্রেস এই বিধানসভা কেন্দ্রে এগিয়ে থাকলেও ফলাফলে দেখা যাচ্ছে অনেক পরিবর্তন। যা ওলট পালট করে দিয়েছে গোটা হিসেবনিকেশ।

২০২৩ এর ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস সর্বাধিক ভোট পেলেও, ফলাফলে দেখা গেল সম্পূর্ণ অন্যরকম চিত্র। জেলা পরিষদ, পঞ্চায়েত সমিতি এবং গ্রাম পঞ্চায়েতে কালীগঞ্জ বিধানসভাভিত্তিক দলভিত্তিক ফলাফল ছিল ঠিক এই রকম:

তৃণমূল কংগ্রেস:
জেলা পরিষদ: ৯৮,১৮১
পঞ্চায়েত সমিতি: ৮৯,৯৯০
গ্রাম পঞ্চায়েত: ১,০১,৫৪৩

বিজেপি:
জেলা পরিষদ: ৪০,৫১৯
পঞ্চায়েত সমিতি: ২৯,৫৪৬
গ্রাম পঞ্চায়েত: ৩০,০৭৯

কংগ্রেস:
জেলা পরিষদ: ১৯,৫৫০
পঞ্চায়েত সমিতি: ১৩,৬৯২
গ্রাম পঞ্চায়েত: ১৬,৮০০

সিপিআইএম
জেলা পরিষদ: ৫৪,৯৬৫
পঞ্চায়েত সমিতি: ৬১,৪২৬
গ্রাম পঞ্চায়েত: ৬০,৮৯০

২০১৬ এবং ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সিপিআইএম কালীগঞ্জ বিধানসভায় প্রার্থী না দিয়ে কংগ্রেস প্রার্থীকে সমর্থন করেছিল, আর ২০২৩-এ ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনে কোনরকম জোট না করে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেই এক লাফে অনেকটা বেড়ে দ্বিতীয়, আর জোট ছাড়া কংগ্রেস সোজা চতুর্থ।

এরপর ২০২৪-এ এল লোকসভা নির্বাচন, সেখানে প্রথম স্থানে তৃণমূল কংগ্রেস থাকলেও দ্বিতীয় স্থানে আবার উলট পুরান। যথারীতি বিজেপি আবার দ্বিতীয় আর সিপিএইএম তৃতীয়। ফলাফল ছিল এইরকম:

তৃণমূল কংগ্রেস : ৯৪,০১৮
বিজেপি : ৬৩,২৪৫
সিপিআইএম : ৩৬,৬৯৮

গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান ও নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কালীগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্র একটি অত্যন্ত গতিশীল এবং রাজনৈতিকভাবে পরিবর্তনশীল এলাকা। ২০১৬ ও ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচন এবং তার পরবর্তী পঞ্চায়েত ও লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল এটাই প্রমাণ করে যে এই আসনে কোনো দল একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।

২০১৬ সালে কংগ্রেসের আধিপত্য থাকলেও ২০২১ সালে তাদের ভরাডুবি হয়। একইসাথে বিজেপি তাদের ভোটব্যাংকে ব্যাপক উন্নতি ঘটায় এবং তৃণমূল কংগ্রেস আগের তুলনায় আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তবে ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে সিপিআইএম হঠাৎ দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসে রাজনৈতিক সমীকরণে নতুন মাত্রা যোগ করে। পরিবর্তনশীল ধারা অব্যাহত থাকে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে, যেখানে সিপিআইএম বিজেপির পিছনে থেকে তৃতীয় স্থানে চলে আসে।

এই সমস্ত পরিবর্তন দেখে বোঝা যাচ্ছে, ভোটাররা এখনও চূড়ান্তভাবে কোনও একটি দলে নিজেদের আস্থার প্রতিফলন ঘটাননি। তারা বারবার নতুন বিকল্প খুঁজছেন। এর পেছনে স্থানীয় স্তরের কাজের গতি, প্রার্থীর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি ও দলীয় সংগঠনের শক্তি—এই সমস্ত বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

২০২৫ উপনির্বাচনের পূর্বাভাস

তৃণমূল কংগ্রেস এখনও পর্যন্ত এই কেন্দ্রে তুলনামূলকভাবে এগিয়ে। শাসক দলের সংগঠন ও প্রশাসনিক সুবিধা তাদের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। তবে তৃণমূলের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে ভোটারদের ক্ষোভ ও বিরোধী ভোটের মেরুকরণ।

বিজেপি-র জন্য এই নির্বাচন একরকম অগ্নিপরীক্ষা। ২০২১ এবং ২০২৪-এর ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, তাদের ভোটব্যাংক স্থির, তবে বৃদ্ধি শ্লথ। সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও প্রার্থী নির্বাচনের ভুল সিদ্ধান্ত তাদের পেছনে টেনে ধরতে পারে।

সিপিআইএম এবং বৃহত্তর বামফ্রন্ট, যদি কৌশলগতভাবে নিজেদের সংগঠন ও প্রচারে মনোযোগী হয়, তবে তারা ভোটারের একটা বড় অংশ আকর্ষণ করতে পারে। বিশেষত ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসা তাদের সম্ভাবনা বাড়িয়েছে।

কংগ্রেস এই কেন্দ্রে ক্রমাগত হ্রাসমান শক্তি হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে। অতীতের দলবদল, সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং পরপর ভরাডুবি তাদের ভোটব্যাংক ভেঙে দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে তাদের পুনরুত্থান আপাতত কঠিন বলেই মনে হচ্ছে।

কালীগঞ্জের উপনির্বাচন একটি মিনি-অ্যাসেম্বলি নির্বাচনের মতোই তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনটি বড় রাজনৈতিক শক্তি — তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেপি ও সিপিআইএম— একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কংগ্রেস কার্যত মার্জিনাল শক্তি হয়ে পড়েছে।

এই উপনির্বাচন শুধু একজন বিধায়ক নির্বাচন নয়, বরং ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পূর্বাভাস হিসেবেও ধরা যেতে পারে। তাই এই ফলাফল রাজ্য রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দিতে চলেছে। কালীগঞ্জের মাটি কাদের হাসাবে, তা জানতে অপেক্ষা ১৯শে জুন পর্যন্ত। তবে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি — আর সেই লড়াই হবে তিনমুখী, একথা এখনই বলা যায়।

ধন্যবাদান্তে 
রাইজ অফ ভয়েসেস