আর কবে? / The Illusion

তিলোত্তমার বিচার চেয়ে অরিজিৎ সিংয়ের নতুন গান “আর কবে” যেন গোটা বাংলায় এক প্রতিবাদের ধ্বনি হয়ে উঠেছে, সাথে জ্বালিয়ে দিয়েছে বিদ্রোহের মশাল। বঙ্গের জনতা আজ তাদের ধৈর্যের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে, পথে নেমে গলা মিলিয়েছে। অরিজিতের সুরে সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, যা বাংলার প্রতিটি সন্তানকে জাগিয়ে তুলছে—বিচারের জন্য, সত্যের জন্য।

এই ক্ষোভের আগুনের মধ্যে দাঁড়িয়ে, বাংলার মানুষ যখন বিচারের আশায় অপেক্ষা করছে, তখন রাজনৈতিক ময়দানে কেউ কেউ নিজেদের বীরত্বের গল্প শোনাতে ব্যস্ত। তিলোত্তমার মতো নির্যাতিতাদের বিচারের জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষের দাবিকে এরা কেবল গরম গরম ভাষণে আর প্রতিশ্রুতিতে মিডিয়া ফোকাসকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে মানুষকে ভুলিয়ে রাখতে চায়। যখন অরিজিতের গান মানুষের মনকে জাগিয়ে তুলছে, তখন এই রাজনীতিকরা তাদের পুরনো ডেডলাইনের গল্প শুনিয়ে নিজেদের বীরত্বের ছাপ ফেলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু বাংলার জনতা এখন আর ফাঁকা কথায় ভুলতে রাজি নয়, তারা সত্যিকারের বিচার চায়, শুধু কথার ফুলঝুরি নয়।

শুভেন্দু অধিকারী, নামটা শুনলেই বাংলার অলিতে গলিতে বীরত্বের গন্ধ পাওয়া যায়। রাজ্য রাজনীতির ময়দানে তিনি যেন এক চিরহরিৎ নাম। কতই না বিপ্লব, কতই না প্রতিশ্রুতি! কিন্তু যখন উনি বলেন, “এই সিবিআই তো মমতা ব্যানার্জীকে ছেড়ে রেখেছে। সিবিআই তো ভাইপোকে ছেড়ে রেখেছে। সিবিআই অফিসারাও যে সবাই একেবারে ম্যানেজ হয় না, তা নয়,” তখন তাঁর গভীর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে। আহা! কি কাণ্ড! একসময় তৃণমূলের কাণ্ডারি ছিলেন, আজ বিজেপির হয়ে সেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন।

শুভেন্দু বাবুর কথার ভঙ্গি শুনলে মনে হয়, তিনি যেন একা হাতে সব দুর্নীতির দানবদের দমন করে ফেলবেন। তিনি অতীতে বারবার ঘোষণা দিয়েছেন, অমুক দিন সরকার পড়ে যাবে, তমুক দিন ভাইপো জেলে যাবে, তাঁর মুখ থেকে এমন বক্তব্য শোনা যেন সত্যিই বাঙ্গবাসীর কাছে আশার বাণী।

কিন্তু… একটু থামুন! গত কয়েক বছরে কি দেখলাম? অমুক দিন এলো, তমুক দিন গেল, কিন্তু সরকার পড়ল না, ভাইপো জেলে গেল না। উল্টে কয়লা দূর্নীতি থেকে ভাইপোর নাম বাদ পড়ে গেল। আর শুভেন্দু বাবু? তিনি এখনও ডেডলাইন দিয়ে যাচ্ছেন, আবারো দেবেন, যেন সেটা কোনো জাদুকাঠির মতো কাজ করবে। অথচ এদিকে, রেশন দুর্নীতিতে অভিযুক্তরা হাসতে হাসতে জামিন পাচ্ছে, আর বগটুই কাণ্ডের সাক্ষীরা বিজেপি যোগ দিয়ে অভিযুক্তদের চিনতে অস্বীকার করছে। মূল অভিযুক্ত লালন শেখ সিবিআই অফিসে ঝুলে পড়ছে। তাহলে কি এটা ধরে নেওয়া যায় বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব শুভেন্দু বাবুর থেকে প্রাক্তন সহযোগী তৃনমূল কংগ্রেসকেই বেশি ভরসা করে শুভেন্দু বাবুকে ছদ্ম বিরোধী বানিয়ে রেখে দিয়েছে। আচ্ছা, সন্দেশখালির কি হল? কোনো সুরাহা মিলল কি?

আচ্ছা, শুভেন্দু বাবু, আপনার এতগুলো ডেডলাইনের কী হলো? আপনি কি পারবেন! নাকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ক্রিপ্টে অভিনয় করতে করতে নিজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে সিবিআইকে গাল পাড়ছেন?

আচ্ছা শুভেন্দু বাবু, আপনার জন্যে কি বিজেপির প্রভাব পশ্চিমবঙ্গে এতটাই কমে গেছে যে, ২০১৯-এর ১৮ সাংসদ থেকে আজ মাত্র ১২ জনে দাঁড়িয়েছে? অথচ এত অর্থবল, মিডিয়া প্রভাব, ইলেক্টোরাল বন্ডের টাকা, এবং সরকারি দূর্নীতি কিভাবে হয় তা ভালো করে জানার অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও আপনি কেন সফল হতে পারছেন না? প্রশ্ন উঠছে।

কিন্তু, আপনি আসলে কি পারবেন? নাকি সেই পুরনো রেকর্ডের মতো কয়েকটা ডেডলাইন দিয়ে, চুপচাপ বসে থাকবেন? তিলোত্তমা কাণ্ডে মৃতদেহের গড়ি আটকানোর সময় আপনি কোথায় ছিলেন? যখন আর জি কর হাসপাতালে ক্রাইম সিন লোপাটের চেষ্টা হচ্ছিল, তখন আপনি কোথায়? আপনি কি করছিলেন? অপেক্ষা! যেদিন রাত দখলের ডাক দেওয়া হয়েছিল, সেদিন আপনি ছিলেন? না। সেই রাতে যখন আর জি কর হাসপাতালে দুষ্কৃতীরা ঢুকে ভাঙচুর চালিয়েছিল, আপনি সেখানেও ছিলেন না। কিন্তু এই প্রতিটি ঘটনায় সেদিন সামনে থেকে যে লড়াই করেছিল, গত বিধানসভা নির্বাচনে আপনার নন্দীগ্রামে মাত্র হাজার ছয়েক ভোট পাওয়া প্রতিদ্বন্দ্বী মিনাক্ষী মুখার্জি এবং দেবাঞ্জন, ধ্রুব, কলতান, দিপ্সীতা, কনিনীকার মত ছাত্র যুব, মহিলারা।

আপনি ছিলেন না শুভেন্দু বাবু, একটিও প্লেস অফ অকোরেন্সে আপনি ছিলেন না, ছিলেন না নন্দীগ্রামে আপনার কাছে পরাজিত প্রতিদ্বন্দ্বী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।

তাহলে আসল কথা কি? হয়ত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আপনাকে ঠিক তখনই লঞ্চ করেন, যখন তাঁর রাজত্বকে টিকিয়ে রাখতে আপনার দরকার হয়। যেমন নন্দীগ্রামে হেরে, পশ্চিমবঙ্গে ২০০+ আসন পেয়ে মাননীয়া নিজের হারকে জিতনেওয়ালা “বাজিগর” ইমেজ বানিয়েছিলেন। আপনি হয়তো তা আজও বুঝতে পারেননি। আপনার দোষ নেই। আসলে আপনি, যেই স্কুলে রাজনীতির প্রাথমিক পাঠ পড়েছেন, সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন মাননীয়া। তাই আপনার দক্ষতায় আজও ওনারই ছাপ রয়ে গেছে।

তবে আপনার ডেডলাইনের যা গতিপ্রকৃতি শুভেন্দুবাবু, আপনার নিন্দুকেরা ইতিমধ্যে বলতে শুরু করেছে আপনি বারে বারে ফেল করে লোক হাসানোর জন্য যথেষ্ট প্রতিভাবান। একাধিকবার নানান অঙ্গীকার করার পরে, বাস্তবে কিছু না করেও এত দিন ধরে মানুষের মনোরঞ্জন করে যাচ্ছেন—এটা কম কথা নয়! বাংলার মানুষ এখন তা পরতে পরতে বুঝতে পারছে। তাই কান পাতলেই কোথাও কোথাও শোনা যাচ্ছে, ফাঁকা বুলি আর ছলচাতুরির রাজনীতি দিয়ে আর কিছু হবে না। শুভেন্দু বাবু, সাবধান হোন! কারণ মানুষ অপেক্ষা করছে, আর সেই দিন বেশি দূরে নয়, যেদিন মানুষের অধিকারের প্রশ্নে এই ফাঁকা হুমকির খেলা খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে।

সমর্থন পেতে হলে, অন্তত কিছু ডেলিভার করতে হয়। আর কিছুই ডেলিভার না করতে পারলে, খেলা শেষ। ভালো থাকুন, শুভেন্দু বাবু।

ধন্যবাদান্তে
তারক সামন্ত