কুমিরের কান্না শোনা যায়? / Crocodile Tears

গতকাল রতন টাটা এবং মাসখানেক আগে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রয়াণের মধ্য দিয়ে ২০২৪ সাল ভারতীয় ইতিহাসে এক সংকটময় মুহূর্তের সাক্ষী হলো। পশ্চিমবঙ্গের শিল্পায়নের স্বপ্ন দেখানোর অন্যতম দুই স্থপতি চলে গেলেন পর পর, রয়ে গেলেন সেই নেত্রী, যিনি বাংলায় শিল্পায়ন ধ্বংস করে নিজের রাজনৈতিক উত্থান নিশ্চিত করেছিলেন—মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ যখন তিনি চোখের জল ফেলছেন, তখন প্রশ্ন উঠছে, এই শোক কি নিছক “কুমিরের কান্না”? বাংলার শিল্প সম্ভাবনার ইতিহাসের দরবারে এই প্রশ্নই আজ বেশি প্রাসঙ্গিক।

সিঙ্গুর, একটি ছোট্ট নাম, কিন্তু তার গুরুত্ব অপরিসীম। ২০০৬ সালে টাটা মোটরসের ন্যানো গাড়ির প্রকল্পের জন্য পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুরকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য শিল্পায়নের মাধ্যমে রাজ্যের শিল্প ও বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। রতন টাটাও সেই স্বপ্নের সঙ্গী ছিলেন। কিন্তু সেই স্বপ্নের যাত্রাপথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে তার তীব্র আন্দোলন সিঙ্গুরকে পরিণত করল রাজনীতির লড়াইয়ের ময়দানে, যেখানে কৃষক এবং শিল্পের স্বার্থের চেয়ে বড় হয়ে উঠল রাজনৈতিক লাভ।
সেই আন্দোলনের ফলাফল—টাটা গাড়ি প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেল, পশ্চিমবঙ্গের বুকে শিল্পায়নের একটি বড় সুযোগ হাতছাড়া হলো। কিন্তু মমতা তার এই আন্দোলনের মাধ্যমে জনসমর্থন আদায় করলেন, যা তাকে শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসাল। ইতিহাসের এক ব্যঙ্গাত্মক পরিহাস, যে আন্দোলন রাজ্যের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করল, সেটাই তাকে রাজনৈতিক সাফল্য এনে দিল।

আজ যখন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং রতন টাটা দুনিয়া থেকে ছুটি নিয়েছেন, তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শোকবার্তা এক নিছক প্রহসনের আয়োজন বলেই মনে করছেন অনেকে। ব্যাপারটা এইরকম যে, তিনি শোকপ্রকাশ করছেন তাদের জন্য, যাদের স্বপ্ন তিনি নিজ হাতে ভেঙে দিয়েছিলেন। এই শোকের আড়ালে কি লুকিয়ে আছে ক্ষমতার কূটকৌশল? জনতার মনে এই প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে।
সিঙ্গুরের আন্দোলন নিয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর চোখের জল যে সন্দেহের জন্ম দিচ্ছে, তা অমূলক নয়। সিঙ্গুরের কৃষকরা কি আজ সত্যিই সুখে আছেন? শিল্পায়ন ছাড়া তারা কি নিজেদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে পেরেছেন? সিঙ্গুর আন্দোলন তাদের জমি ফিরিয়ে দিলেও, সেটা কি অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রতিশ্রুতি দিতে পেরেছে? উত্তরটা অস্বস্তিকর।
সিঙ্গুর আজও সেই উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত, যা টাটা প্রকল্প নিয়ে আসতে পারত। বুদ্ধদেব এবং রতন টাটা পশ্চিমবঙ্গের শিল্পায়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচনের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা মমতার আন্দোলনের জোয়ারে হারিয়ে গেছে। আজ মুখ্যমন্ত্রী যে শোকবার্তা দিচ্ছেন, তা কি বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ভূমিকার জন্য অনুশোচনা, নাকি নিছক জনসমর্থন ধরে রাখার চেষ্টা?

কোনো সন্দেহ নেই, রাজনীতিতে শোকও একটি কৌশল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শোকপ্রকাশ তার রাজনৈতিক ইমেজ মেরামতের চেষ্টা হতে পারে, কারণ ইতিহাস তাকে সেই নেত্রী হিসেবেই মনে রাখবে, যিনি সিঙ্গুরের শিল্পায়নকে ধ্বংস করে রাজনৈতিক মঞ্চে সাফল্য পেয়েছিলেন। কিন্তু তার শোক সিঙ্গুরের বঞ্চিত মানুষদের জন্য নয়, যারা সেই স্বপ্নের ফল থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
এই কান্না কি কুমিরের কান্না নয়? প্রশ্ন উঠছে।
ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস
Comments are closed.