আলিমুদ্দিনের চৈতন্যোদয় / The Political Renaissance

২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি হচ্ছে। দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রান্তিক অবস্থানে থাকার পর সিপিআইএম এবার এক অভূতপূর্ব কৌশল নিতে চলেছে। দলীয় শীর্ষ সূত্রে জানা যাচ্ছে, স্বাধীন লড়াইয়ের পথে হেঁটে অন্তত ২৫০ থেকে ২৭০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা—যা হবে ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে সিপিআইএমের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রার্থী তালিকা। ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত ও ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলই এই কৌশলের ভিত্তি, যা প্রমাণ করেছে—কাস্তে-হাতুড়ি-তারা প্রতীক এখনও বাংলার রাজনীতিতে কার্যকর ফ্যাক্টর।
বিশ্বস্ত সূত্রে খবর মিলছে, আসন্ন ২০২৬ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে সিপিআইএম অভূতপূর্ব এক কৌশল নিয়ে মাঠে নামতে চলেছে। দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ধারাবাহিক ভোট ক্ষয়ের পর এই প্রথমবার দলীয় নেতৃত্বের ভেতরে এমন এক আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে, যা সরাসরি মাঠের অভিজ্ঞতা থেকে জন্ম নিয়েছে। ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন এবং ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে—যেখানে কাস্তে-হাতুড়ি-তারার প্রতীক উপস্থিত, সেখানে ভোটারের একটি বড় অংশ এখনও সিপিআইএমের প্রতি আস্থা রাখছে। তার ওপরে অনুপ্রবেশের নামে ভিনরাজ্যে বাঙালী হেনস্থা বিজেপির তৃণমূল বিরোধী ভোটব্যাঙ্কে যে থাবা যে বসিয়েছে তা উত্তরবঙ্গের মত বিজেপি গড়েও বামেদের বিগত ধর্মঘটের চোখে পড়বার মত প্রভাবেই স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়েছে। পাশাপাশি পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে সিপিআই(এম)-এর বিভিন্ন কর্মসূচি খেটেখাওয়া মানুষদের জীবনে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। যদিও এই আস্থা দলকে এখনই বিকল্প সরকার হিসেবে তুলে ধরছে না, তবুও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ যে বাস্তবতা, তা হলো—এই প্রতীক এখনও বাংলার মাটিতে কার্যকর।

সিপিআইএমের ভেতরে এই মুহূর্তে যে আলোচনাটা ক্রমশ জোরালো হচ্ছে, তা হলো জোট রাজনীতির সীমাবদ্ধতা। গত কয়েকটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছে, কংগ্রেস বা অন্য শরিক দলের সঙ্গে জোটে গিয়ে আসন সমঝোতা করলেই ভোট বাড়ে না, বরং কমে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, যেখানে সিপিআইএম শরিক প্রার্থীর পক্ষে সরে দাঁড়িয়েছে, সেখানে ভোটের গড় পড়ে গেছে। বিপরীতে, যেখানে সিপিআইএম নিজস্ব প্রতীকে লড়েছে, সেখানে ভোট বেড়েছে। এই পরিসংখ্যান একদিকে যেমন কৌশল নির্ধারণে প্রভাব ফেলছে, অন্যদিকে কর্মী-সমর্থকদের ভেতরেও এক নতুন আস্থা তৈরি করছে। তারা মনে করছে, কাস্তে-হাতুড়ি-তারাই তাদের পরিচয়, আর এই পরিচয়কে সামনে রেখে লড়াই করলেই ভোটাররা তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে।
২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন এই তত্ত্বকে বাস্তবে প্রমাণ করেছে। প্রায় সাত কোটি ভোটারের রাজ্যে যেখানে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এখন কার্যত দ্বিমুখী—তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে—সেই পরিস্থিতিতেও সিপিআইএম এককভাবে লড়ে ৬৮ লক্ষাধিক ভোট তুলতে পেরেছে। আরও তাৎপর্যপূর্ণ হলো, প্রতি আসনে গড় ভোট বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৪ হাজারের কাছাকাছি। এর মানে হলো, দলীয় প্রতীকে লড়াই করলেই ভোটাররা সংগঠনের পাশে ফিরে আসছে। অনেক গ্রামীণ অঞ্চলে যেখানে সিপিআইএমের উপস্থিতি গত এক দশকে কার্যত শূন্য হয়ে গিয়েছিল, সেখানে নতুন করে কর্মী-সমর্থকের উত্থান ঘটেছে। এই অভিজ্ঞতাই নেতৃত্বকে বুঝিয়েছে, স্বাধীন লড়াই ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
লোকসভা ২০২৪-এ এই প্রবণতার পুনরাবৃত্তি ঘটে। যদিও আসনসংখ্যা কম ছিল এবং জোটের কারণে অনেক এলাকায় সিপিআইএম প্রার্থী দাঁড়াতে পারেনি, তবুও যেখানে কাস্তে-হাতুড়ি-তারার প্রতীক দেখা গেছে, সেখানে ভোটের গড় বেড়েছে। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৪-এ সিপিআইএমের মোট ভোট কিছুটা কমলেও, প্রতি আসনে গড় ভোট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ হাজারের ওপরে। এই পরিসংখ্যানই দলীয় মহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। কারণ, এর থেকে স্পষ্ট যে দলীয় প্রতীকের উপস্থিতি ভোটারদের কাছে এখনও বাস্তব প্রভাব বিস্তার করছে।

অন্যদিকে, জোট রাজনীতির অভিজ্ঞতা সিপিআইএমকে আরও সতর্ক করেছে। নেতৃত্বের ভেতরে এখন প্রায় সর্বসম্মত মত—জোট মানেই আসন সমঝোতা, আর আসন সমঝোতা মানেই ভোট ক্ষয়। কংগ্রেস বা অন্য শরিকরা যেখানে দাঁড়ায়, সেখানে সিপিআইএমের ভোটাররা অনেক ক্ষেত্রেই বিভ্রান্ত হয়। কেউ কেউ ভোট দেয়, কেউ দেয় না। কিন্তু সিপিআইএমের প্রতীক দেখলেই ভোটাররা সহজে মনস্থির করে। এর ফলে গড় ভোট বাড়ে, যা ভবিষ্যতে আসনে রূপান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করে। তাই ২০২৬ বিধানসভা নির্বাচনে নেতৃত্বের লক্ষ্য—যত বেশি সম্ভব আসনে কাস্তে-হাতুড়ি-তারার প্রতীককে দৃশ্যমান করা।
এই কৌশলের প্রেক্ষিতে দলের ভেতরে ইতিমধ্যেই একটি স্পষ্ট রূপরেখা তৈরি হয়েছে। সূত্রের খবর, সিপিআইএম অন্তত ২৫০ থেকে ২৭০ আসনে প্রার্থী দিতে চলেছে। যদি এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়, তবে এটি হবে ১৯৬৪ সালে দল প্রতিষ্ঠার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় সিপিআইএমের সর্বাধিক প্রার্থী দেওয়ার রেকর্ড। অতীতে বামফ্রন্ট আমলেও শরিক দলগুলির স্বার্থ রক্ষার জন্য সিপিআইএম বহু আসনে সরে দাঁড়াত। কিন্তু এবারে সেই ছাড় দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ হতে চলেছে। নেতৃত্ব মনে করছে, শরিকরা যতই ক্ষুব্ধ হোক না কেন, দীর্ঘমেয়াদে সিপিআইএমের টিকে থাকার জন্য এই পথই সঠিক।
তবে এই কৌশল শরিকদের অস্বস্তি বাড়িয়েছে। আরএসপি ও ফরওয়ার্ড ব্লক ইতিমধ্যেই নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। এতদিন তারা কয়েক ডজন আসনে লড়াই করার সুযোগ পেত, কিন্তু এবারে এক অঙ্কের আসনেই সীমাবদ্ধ হতে পারে। ফলে এদের ভেতরে চাপা ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, শরিকদের বাদ দিয়েই সিপিআইএম এককভাবে লড়াইয়ে নামতে পারে। এতে তাৎক্ষণিকভাবে ফ্রন্টের ঐক্য নষ্ট হলেও দীর্ঘমেয়াদে সিপিআইএমের সংগঠন পুনর্গঠনে তা সহায়ক হতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি নিছক প্রার্থী সংখ্যা বাড়ানোর কৌশল নয়। বরং এর পেছনে একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক বার্তা রয়েছে। সিপিআইএম চায় ভোটারদের সামনে আবারও নিজেদের প্রতীককে দৃশ্যমান করতে। অনেক বছর ধরে বাংলার রাজনীতিতে কাস্তে-হাতুড়ি-তারা প্রতীক মানেই ছিল প্রধান শক্তি। সেই প্রতীককে ভোটারদের চোখের সামনে থেকে সরিয়ে দিলে দলীয় পরিচয় দুর্বল হয়ে যায়। তাই এবার নেতৃত্বের স্পষ্ট নির্দেশ, প্রতীককে যত বেশি সম্ভব আসনে দৃশ্যমান করতে হবে।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই কৌশলের তাৎপর্য আরও বেশি। তৃণমূল কংগ্রেস এখনও রাজ্যের প্রধান শক্তি, তাদের ভোটসংখ্যা ২.৭ থেকে ২.৮ কোটির মধ্যে স্থিতিশীল। বিজেপিও ২.৩ কোটি ভোট নিয়ে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে টিকে আছে। এই দুই শক্তির দ্বিমুখী লড়াইয়ের ভেতরেও সিপিআইএম যদি ১ কোটি বা তার বেশি ভোট তুলতে পারে, তবে তা বাংলার রাজনীতির সমীকরণ পাল্টে দিতে পারে। যদিও এই ভোট সংখ্যাই দলকে সরকারে বসাবে না, তবে আসনসংখ্যা বাড়িয়ে এক শক্তিশালী বিরোধী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সিপিআইএম যদি এককভাবে ২৫০ থেকে ২৭০ আসনে লড়ে, তবে অন্তত ৫০ থেকে ১০০ আসন ফেরানো সম্ভব। এর ফলে রাজ্যের রাজনৈতিক ভারসাম্যে বড় পরিবর্তন আসবে। একদিকে তৃণমূল-বিজেপি দ্বন্দ্বে ক্লান্ত ভোটাররা নতুন বিকল্প খুঁজবে, অন্যদিকে কংগ্রেস বা ছোট শরিকদের প্রভাব আরও কমে যাবে। এর ফলেই সিপিআইএমের জন্য নতুন রাজনৈতিক ক্ষেত্র তৈরি হতে পারে।
সবশেষে বলা যায়, ২০২৬ বিধানসভা নির্বাচন শুধু একটি রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা নয়, বরং সিপিআইএমের জন্য অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই। ২০২৩ ও ২০২৪-এর অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নেতৃত্ব এখন বিশ্বাস করছে, কাস্তে-হাতুড়ি-তারা শুধু অতীতের প্রতীক নয়, বর্তমানের বাস্তব শক্তি। তাই আসন্ন নির্বাচনে এই প্রতীককে সর্বাধিক আসনে তুলে ধরা হবে। শরিকদের ক্ষোভ থাকলেও দলীয় অভ্যন্তরে এখন একটি বার্তাই স্পষ্ট—জোট নয়, প্রতীকই অস্ত্র। পুজো শেষ হলেই আলিমুদ্দিনে চূড়ান্ত বৈঠক বসবে, আর সেখানেই ঘোষণা হতে পারে এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। বাংলার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে নতুন সমীকরণ তৈরি করবে এবং কাস্তে-হাতুড়ি-তারাকে আবারও রাজনৈতিক কেন্দ্রে নিয়ে আসবে।
ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস
RABIUL ISLAM SK
Only for CPIM
Anshu dev Adhikari
Very good dicision.I agree with this decision.
Shakti Pada
Absolutely correct decision
Santanu Hatua
আমরা শুধুমাত্র প্রতীকে লড়াই করবো। সরকার পরিবর্তন হবে না তবে কয়েকটি আসন পাওয়া ই আমাদের লক্ষ্য মাত্রা। আরও সঠিক বিশ্লেষণ এর প্রয়োজন আছে। এই মুহূর্তে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে আছে। সেখানে আমাদের আর ও সচেতন হতে হবে। লাল সেলাম