ঠ্যালার নাম…/ Game On!

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে প্রতিদিন নতুন নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। কাগজে-কলমে, টেলিভিশনের পর্দায় কিংবা রাজনৈতিক সভায়, বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসকে একে অপরের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই তুলে ধরা হয়। প্রচারে বারবার বলা হয়, এই লড়াই আসলে বিজেপি বনাম তৃণমূল। কিন্তু গভীরে তাকালে বোঝা যায়, বাস্তব চিত্রটি অনেক জটিল এবং বহুস্তরীয়।

প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফাঁকফোকর

তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে নেতা-কর্মীদের ফুলবদল এখন আর নতুন খবর নয়। প্রাক্তন মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক থেকে শুরু করে জেলা বা ব্লক স্তরের গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক নিয়মিতই এক দল থেকে আরেক দলে যোগ দিচ্ছেন। গত কয়েক বছরে এভাবে তৃণমূল থেকে বিজেপি কিংবা বিজেপি থেকে তৃণমূলে যাওয়ার অসংখ্য উদাহরণ রাজ্য রাজনীতির ইতিহাসে জমা হয়েছে।

এই অভ্যন্তরীণ স্রোত আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, তৃণমূল ও বিজেপির বিরোধ যতটা চরম বলে উপস্থাপিত হয়, বাস্তবে তা ক্ষমতার সমীকরণে সীমাবদ্ধ। ব্যক্তিগত ক্যারিয়ার বাঁচানো, স্থানীয় প্রভাব ধরে রাখা বা ভবিষ্যতের সম্ভাব্য লাভ নিশ্চিত করার জন্য রাজনীতিকেরা অনায়াসেই এক শিবির থেকে অন্য শিবিরে গিয়েছেন, যাচ্ছেন, ফিরে এসেছেন।

টার্গেট: সিপিআইএম

এই প্রেক্ষাপটে বিজেপির রাজনৈতিক কৌশল বুঝতে সুবিধা হয়। তৃণমূলকে বিজেপি আক্রমণ করে বটে, তবে তা কখনোই সর্বাত্মক বা প্রাণঘাতী নয়। কারণ, বিজেপি খুব ভালো করেই জানে, তৃণমূল যদি একেবারে ভেঙে পড়ে, তবে বিকল্প শক্তি হয়ে উঠবে বামফ্রন্ট, বিশেষ করে সিপিআইএম। আর এটাই বিজেপি ও তার আদর্শিক ভরকেন্দ্র আরএসএস-এর কাছে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সম্ভাবনা।

ফলে দেখা যায়, বিজেপির অনুনয় বিনয় থেকে আক্রমণ লক্ষ্য করে কেবল সিপিআইএমকে। শুধু দলকেই নয়, সেই সব ভোটারকেও, যারা মমতার বিরুদ্ধে হলেও বিজেপিকে বিশ্বাস করেন না। বিজেপি বারবার সেই ভোটারদের বোঝাতে চায়, মাঝামাঝি রাস্তা বলে কিছু নেই; আপনার সামনে আছে মাত্র দুটি বিকল্প, হয় তৃণমূল অথবা বিজেপি।

কৌশলের প্রকাশ্য রূপ

সাম্প্রতিক সময়ে শুভেন্দু অধিকারীর বক্তব্যে এই কৌশল আরও পরিষ্কারভাবে সামনে এসেছে। তিনি বলেন:

“সিপিএম-ই তো হিন্দু ভোট কাটছে, কেটে তৃনমূলকে রাখছে। সিপিএম হইতে সাবধান, সরাসরি সিপিএমকে ভোট না দিয়ে, যে কথা সজল ঘোষ বলেছে, নয় প্রো মমতা, নয় আন্টি মমতা। যে কোনো একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মমতাকে রাখতে চান তো সরাসরি ওখানে, আর মমতাকে হারাতে চান তো পদ্ম ফুলে। আর কোন মাঝখানে রাস্তা নেই।”

শুভেন্দু অধিকারী, বিরোধী দলনেতা, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা

এখানে লক্ষণীয়, এই কথাগুলো তিনি বলেছেন সদ্য-প্রাক্তন তৃণমূল নেতা তাপস রায়কে পাশে বসিয়ে। অর্থাৎ, তৃণমূল অন্দরমহল থেকে আসা তৃনমূল গভর্নমেন্টের প্রাক্তন মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী বিজেপির ঘরে বসে, পাশে তৃনমূলের সদ্য প্রাক্তন তাপস রায়কে পাশে বসিয়ে তৃণমূলেরই প্রাক্তন নেতা সজল ঘোষকে উদ্ধৃত করছেন, আর শেষ পর্যন্ত নিশানা করছেন সিপিআইএমকে, যেটা এনারা প্রত্যেকেই তৃণমূল কংগ্রেসের থাকতেও একইভাবে করতেন। রাজনীতির এই দৃশ্য নিছক কাকতালীয় নয়; এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে বৃহত্তর পরিকল্পনা।

মমতা: আরএসএস–বিজেপির কৌশলগত ‘দুর্গা’

বাংলার জনসংখ্যা বাস্তবতাও এই সমীকরণ বুঝতে সাহায্য করে। প্রায় ৩০ শতাংশ মুসলিম ভোটার নিয়ে এই রাজ্যে বিজেপির এককভাবে ক্ষমতায় আসা কার্যত অসম্ভব। এই বাস্তবতায় আরএসএস-বিজেপির কাছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে উঠেছেন একপ্রকার “কৌশলগত দুর্গা” – যাকে টিকিয়ে রাখলে রাজ্যে সিপিআইএমের পুনরুত্থান ঠেকানো যায়।

এজন্যই বিজেপির আক্রমণ কখনোই মমতাকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে নয়, বরং আক্রমণের ভান করে তাকে টিকিয়ে রাখাটাই আসল কৌশল। কারণ, মমতা থাকলে তৃণমূল-বিরোধী ভোটের একটি বড় অংশ বিজেপির দিকে আসবে, বাকিটা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে। কিন্তু সিপিআইএম শক্তিশালী হলে বিজেপি-তৃণমূল উভয়েরই ক্ষতি হবে, আর পশ্চিমবঙ্গে সিপিআইএমের শক্তি বাড়লে, গোটা ভারতে সেই প্রভাব সঞ্চারিত হবে। তাই মূল আক্রমণের লক্ষ্য বামেরা।

বিভাজনের রাজনীতি

সব মিলিয়ে স্পষ্ট হয়ে যায়, রাজনীতির বর্তমান নাট্যমঞ্চে বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের প্রকাশ্য বিরোধ অনেকাংশেই প্রতীকী। আড়ালে দুই শিবিরের বোঝাপড়া এক জায়গায় এসে মিলে যায়: সিপিআইএম ও বামপন্থী শক্তিকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করে রাখা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে লড়াই করল তৃনমূল, বিজেপি এবং কংগ্রেস, আর তৃনমূল কংগ্রেসের কালীগঞ্জ জয়ের উল্লাসে বলি হয়েছিল নয় বছরের মেয়েটা। উপনির্বাচনে জিতল তৃনমূল, হারল বিজেপি আর কংগ্রেস, কিন্তু মরল কে? তামান্না।ছোট্ট মেয়েটির গায়ে বোম পড়ার কারণ একটাই, তার পরিবার সিপিআইএম সমর্থক।

সুতরাং ভোটারদের জন্য প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ: এই নাটকীয় লড়াইয়ের আসল প্রতিপক্ষ কারা?বিজেপি ও তৃণমূল কি সত্যিই চরম শত্রু? না কি তাদের মধ্যে অদৃশ্য বোঝাপড়ার সেতু তৈরি হয়ে গেছে যেখানে দু’পক্ষই পরস্পরের অস্তিত্ব একবাক্যে মেনে নিয়ে একমাত্র বামপন্থাকেই আক্রমণের লক্ষ্য করেছে?

আজকের রাজনীতিতে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া জরুরি। কারণ গণতন্ত্রে আসল শক্তি জনগণের হাতে, আর সেই শক্তিকে কোথায় ব্যবহার করা হবে, সেটাই ঠিক করে দেবে আগামী দিনের ইতিহাস। তাই পরিশেষে বলাই যায়, রাজ্যের বিরোধী দলনেতা হোক বা মুখ্যমন্ত্রী, ঠ্যালার নাম একটিই, সিপিআইএম।

ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস