‘পাহাড় ভাসছে’ , উত্তরবঙ্গ ‘উত্তর’ খুঁজছে / North Bengal Betrayed

আক্রান্ত বিজেপির খগেন মুর্মু হাসপাতালে শায়িত। মুখে ব্যান্ডেজ। পাশে দাঁড়িয়ে তৃনমূলের ‘মানবিক’ মাননীয়া।

অথবা বাম হাতে আঘাত পাওয়া বিজেপির শঙ্কর ঘোষের ডানহাতে ব্যান্ডেজ করে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসা।
আর তারপর আচমকা বাংলার বদলা ত্রিপুরার আগরতলায়।ওখানকার শাসক বিজেপি ভাঙচুর চালালো খুঁজে না পাওয়া যাওয়া ত্রিপুরা তৃণমূলের সদর অফিসে।
এরপর জনৈক শাসক মুখাপাত্রের দলবল নিয়ে ত্রিপুরাযাত্রা ও আগরতলা এয়ারপোর্টে অবস্থান- বিক্ষোভ।
এদিকে একদা রাজভবনে ‘পিসরুম’ খুলে বসা কালা চশমার দিল্লি যাত্রা, রাষ্ট্রপতি সাক্ষাৎ ও পশ্চিমবঙ্গের আইন শৃঙ্খলা নিয়ে তাঁর কাছে রিপোর্ট পেশ।
এবং সবশেষে রোহিঙ্গা-মুসলমান হয়ে ৩৫৫ – ৩৫৬ র দাবি।
গত ৫-৬ দিন ধরে দিন রাত টিভিতে খবরের চ্যানেল গুলোতে এগুলোই চলছে।
হঠাৎ করে বাংলা ও বাঙালীর খবর টবর রাখেন না এমন কেউ টিভি খুলে বসলে তিনি জানতেই পারবেন না বিগত ৫-৬ দিন ধরে গোটা উত্তরবঙ্গ ভয়াবহ বন্যার কবলে। লাখো মানুষ গৃহহীন হয়ে ত্রান শিবিরে। চারিদিকে ত্রাণের হাহাকার।

এটাই বঙ্গ ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ার এগিয়ে থাকা ও বাঙ্গালীকে এগিয়ে রাখা। চোখে চোখ রেখে খবর করা। যেখানে বন্যার্ত উত্তরবঙ্গের লাখো মানুষের দুর্দশার থেকে এগিয়ে থাকে আক্রান্ত ‘দলবদলু’ খগেন মুর্মুরা । বন্যাপীড়িত গোটা উত্তরবঙ্গের চোখে চোখ রাখতে না পেরে শেষমেশ বিরোধীদলনেতার তল্পিবাহকে পর্যবসিত হওয়া।
আচ্ছা কেন এই বন্যা? তা নিয়ে কোথাও কোন বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা নেই। নেই কোন প্রতিবেদন। খালি চিৎকার আর তরজা।
ভুটানের মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়েছে জলঢাকা, তোর্সা, রেতি, সুকৃতি, পানা, বাসরা, রায়ডাক, সংকোশ-সহ একাধিক নদী যা পরবর্তীতে এরাজ্যে ঢুকেছে। ভুটান থেকে ডুয়ার্সে ছোটো-বড়ো ৭২টি নদী ও ঝোরা নেমেছে। গত সপ্তাহে গোটা উত্তরবঙ্গ, সিকিম ও ভুটানে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়। ফলে এইসব নদী ও ঝোরা গুলোতে জলস্ফীতির কারণে গোটা উত্তরবঙ্গে এই বন্যার সূত্রপাত। কিন্তু ব্যাপারটা এমন তো নয় যে আগে বাম আমলে এই নদী ও ঝোরা গুলোর কোন অস্তিত্ব ছিল না। উত্তরবঙ্গ , সিকিম বা ভুটানে বৃষ্টিপাতও হতো। তাতে উত্তরবঙ্গের কিছু কিছু জেলার বিশেষ বিশেষ অংশ প্লাবিতও হতো। কিন্তু শেষ কবে গোটা উত্তরবঙ্গ, পাহাড় থেকে সমতল, মিরিক থেকে ডুয়ার্স এমন ভয়াবহ বন্যার সম্মুখীন হয়েছে কেউই মনে করতে পারছে না। কেন এই ভয়াবহতা ?
নদী বিশেষজ্ঞদের মতে এর কারণ অনেকগুলো। বিগত দু-দশকের ওপর উত্তরবঙ্গের নদী বাঁধগুলোর কোন রক্ষনাবেক্ষণ বা মেরামতি হয় না বললেই চলে। পাশাপাশি গত এক দশক ধরে চলেছে শাসক ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী কাম লুম্পেনদের দু-পয়সা কামানোর লোভে নদী অববাহিকা ও সন্নিহিত ডুয়ার্স অরন্যাঞ্চল থেকে দেদার পাথর-বালি ও গাছ কেটে বেচে দেওয়ার প্রবণতা। যাকে বলে হরির লুঠ, তাই চলছে উত্তরবঙ্গ জুড়ে। এমনকি নদীর চর, তাকেও এরা ছাড়েনি। চরের জমিরও পরচা বানিয়ে বেচে দিয়ে লাখ লাখ টাকা কামিয়েছে এরা। ফলে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ ও জনবসতির মধ্যে যে ন্যুনতম সীমারেখা বা দূরত্ব থাকা প্রয়োজন সেটাও আজ উধাও হয়ে গেছে। এক দশক আগেও উত্তরবঙ্গে যে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ছিল তা আজ লাটে উঠেছে। ফলে সামান্য বৃষ্টিপাতেই আজ ভেসে গেছে গ্রামের পর গ্রাম, একের পর এক পাহাড়ি জনবসতি, বস্তি-মহল্লা। ধূলিসাৎ একের পর এক বাঁধ। ধ্বসে গেছে ব্রিজ -রাস্তা। এদিকে মাননীয়া বলে দিয়েছেন সিকিম ও ভুটান জল ছেড়ে বাংলায় বন্যা করে দিয়েছে, আর এটা নিয়ে বিজেপি নেতৃত্ব তু-তু-ম্যায় -ম্যায় করছে তৃণমূলের সাথে।
কিন্তু এখানে বলে রাখা দরকার গোটা বন্যা পীড়িত উত্তরবঙ্গের প্রায় সবকটা সাংসদ প্রধান বিরোধীদল বিজেপির। অধিকাংশ বিধায়কও ঐ বিরোধীদলটির দখলে। তা শাসক তৃণমূল যখন বিগত বেশ কিছু বছর ধরে উত্তরবঙ্গের প্রাকৃতিক ও বনজ সম্পদ দেদার লুঠপাট করে আজকের এই ভয়াবহ বন্যার পথ প্রশস্ত করছিল তখন বিজেপির এই স্থানীয় বিধায়ক -সাংসদরা কি করছিলেন ? সারাবছর ধরে হিন্দ-মুসলিম সাম্প্রদায়িক ভাগাভাগি ও উত্তেজনা ছড়ানো আর গোর্খা-কামতাপুর-কোচ ইত্যাদি জনগোষ্ঠীকে উস্কে দিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদে মদত দেওয়া ছাড়া এদেরকে আপনি আর কোথাও পাবেন না। বিজেপির কোন দরদী সমর্থকও উত্তরবঙ্গের প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ নিয়ে তাদের দল একটা নজরকাড়া আন্দোলন করেছে এমন নজির আমাদের সামনে বা জনসমক্ষে হাজির করতে পারবেন না। তবে কি এমন ঠুঁটো জগন্নাথ অপদার্থ বিরোধীদলের জন প্রতিনিধি নির্বাচন করেই গোটা উত্তরবঙ্গ ডুবলো ? শাসকের চোখে চোখ রেখে আন্দোলন সংগঠিত করে প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ বন্ধ করা ও বাঁধগুলোর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতির ব্যবস্থা করাটা কি উচিৎ ছিল না বঙ্গ বিজেপির উত্তরবঙ্গ থেকে গণ্ডায় গণ্ডায় নির্বাচিত সাংসদ বিধায়কদের ? তৃণমূল কংগ্রেস মানেই যে চোর-চিটিংবাজ-লুম্পেন টাইপ এটা আজ শুধু উত্তরবঙ্গ নয়, গোটা বাংলার মানুষ মেনে নিয়েছে। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল বিজেপি এমন অপদার্থ কেন ? এদের খালি গরম গরম ভাষণবাজি আর বাগড়ম্বর, অথচ কাজের বেলায় কাঁচকলা! দেশের সরকার চালায় এরা, দেশের প্রধানমন্ত্রী এদের দলের যিনি নাকি একাধারে চৌকিদার ও বিশ্বগুরু! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তো নাকি বাঁ-হাত ঘোরালেই মাস্টার্সস্ট্রোক বেরোয় ! এমনকি রাজ্যপালও নাকি এঁদের দলের যিনি শুধু নামে নয়, কাজেও যে কোন দিন ‘সুভাষ’ হতে পারেন, মানে রাজ্যপাল হয়ে আসবার সময় ঢক্কা নিনাদটা তো তেমনই শোনা গেছিল বা পেটানো হয়েছিল। অথচ এরা সবাই মিলে শায়েস্তা করতে পারছে না চিটিংবাজ-লুম্পেন পিসি-ভাইপো পার্টিটাকে! সত্যি চায় কি শায়েস্তা করতে নাকি “সেটিং”ই সত্য! নাকি শাসকের প্রাকৃতিক ও বনজ সম্পদ লুঠ করে কামানো টাকার একটা ভাগ এরাও পায় তাই এই ইস্যুতে হাত গুটিয়ে বসে থাকে ? তাহলে বামেদের কে সরিয়ে বিরোধী পরিসরে বিজেপিকে দু-হাত তুলে ভোট দিয়ে উত্তরবঙ্গের লাভ কি হলো ? এমনই এক গুচ্ছ প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে গোটা উত্তরবঙ্গের মানুষ। আমাদের কাছে অন্তত এমনটাই খবর। এটা বঙ্গ বিজেপির নেতারা জানতে পারছেন কি ? এনারা কি ভাবছেন, এ যাত্রাও ‘বাইনারি’ সেট করে বঙ্গ মিডিয়া এনাদেরকে সম্মানজনক ৭০-৮০ বা ৯০ টা আসন পাইয়ে দিয়ে এ যাত্রা উতরে দেবে! সেটা কিন্তু এবার ২০২৬ এ অতটা সোজা নয়।
এখানে বোঝা দরকার, বঙ্গ মিডিয়া যতই চিল-চিৎকার করুক, নাগরাকাটার আসল ঘটনা কিন্তু ত্রান দিতে গিয়ে খগেন মুর্মূ-শঙ্কর ঘোষদের আক্রান্ত হওয়া নয়, এখানকার আসল ঘটনা হলো গোটা নাগরাকাটা ব্লক বন্যা প্লাবিত। হাজারো মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে পথে বসেছেন। বেশ কিছু পরিবার হারিয়েছেন তাদের স্বজন, ঘরের লোকদের। আর তারজন্য শাসক তৃণমূলের লুঠপাট ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা যতটা দায়ি ঠিক ততটাই দায়ী উত্তরবঙ্গ থেকে বিজেপির টিকিটে নির্বাচিত এইসব অপদার্থ সাংসদ-বিধায়কেরা। তাই বন্যার এক বুক জলে দাঁড়িয়ে উত্তরবঙ্গের মানুষজন শুধু ত্রাণ নয়, ইতিউতি পরিত্রাণও খুঁজতে শুরু করেছে এই দুইদলের হাত থেকে। সমাধান খুঁজছে উত্তরবঙ্গ।
চল্লিশ গাড়ির কনভয় নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর একদা দলীয় সহকর্মী ও বর্তমান বিরোধী দলনেতা এক ঝলক গাড়ির কাঁচ নামিয়ে সেদিক পানে তাকিয়েই বোধহয় সে জল মাপতে পেরেছেন। আর তাই কার্নিভালের নাচন কোদন শেষ হতেই বন্যা পীড়িত গ্রামের ভেতর না ঢুকে শুধু খগেন মুর্মুকে দেখে আর কিছু প্রশাসনিক বৈঠক সেরে মাননীয়া উত্তরবঙ্গ সফর শেষ করে ফিরে এলেন। শুভেন্দু অধিকারীরাও নিজেদের অপদার্থতা ঢাকতে মরিয়া হয়ে উত্তরবঙ্গ থেকে নজর ঘোরাতে ত্রিপুরা এপিসোড খাড়া করলেন। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হলো। মাননীয়া ও তার দলবল পেয়ে গেলেন দরাকারি ‘এসকেপ রুট’টা। ফলে ফের একবার খাড়া হলো “সেটিং” তত্ত্ব। আর সে তত্ত্বকে খারিজ করতে ফের সেই চির পরিচিত রাজভবন, রাষ্ট্রপতি,৩৫৫, ৩৫৬ মায় দিল্লির দলীয় হাইকম্যান্ড, সবাইকে জড়িয়ে বঙ্গ বিজেপির নেতারা একটা জগাখিচুরি বানিয়ে মিডিয়াকে দিয়ে মানুষকে খাওয়াতে চাইলেন। উত্তরবঙ্গের মানুষ আদৌ খেল কি ?
একটু খেয়াল করলে দেখবেন মিডিয়া গত এক দশক ধরে আপনাকে আমাকে একটা কথা পাখি পড়ানোর মত পড়িয়ে আসছে। রাজনীতি নাকি পারসেপ্সনের খেলা ? কেন বলুন তো ? সে কি তারা রাজনৈতিক দলগুলোর অকাজ-কুকাজ ঢেকে ‘ইমেজ বিল্ডিং’ এর ইজারা পেয়েছে বলে ? তবে কি রাজনীতিতে ভালো কাজের কোন দাম নেই ? ইনফ্যাক্ট একটু খেয়াল করলেই দেখবেন গত এক দশকে ভারতের গণতন্ত্র নিজের অজান্তেই কর্পোরেট মিডিয়া হাউজগুলোর তৈরি এই পারশেপ্সনের ওপর দাঁড়িয়ে পড়েছে। এটাই দক্ষিণপন্থার ভিত্তি। ভোট এলেই এসে যায় নিউজ চ্যানেল গুলোতে ওপিনিয়ন পোলের নামে জনমত তৈরির খেলা। খেলা বলছি, কারণ এখন বহুক্ষেত্রেই এই সমীক্ষা গুলোর ফল মেলে না। আগেও মিলতো না , কিন্তু এখনকার মত এত ঘনঘন না মেলবার নজিরও আগে ছিল না। যদিও আগে এখনকার মত সারা বছর ধরে একপেশে খবর পেশের মাধ্যমে জনতা জনার্দনের মগজ ধোলাই চলতো না। অথচ তারপরেও এখন সমীক্ষা গুলো মেলে না, কারণ সমীক্ষা গুলোর উদ্দেশ্যই হলো জনমত গঠন বা পারসেপ্সন বিল্ডিং। মানে মিডিয়া হাউজগুলো আজকাল শাসকের স্বপক্ষে পারসেপ্সন বিল্ডিং এর মেশিনারিতে পরিণত হয়েছে। তাই বন্যার খবর ও তার বস্তুনিষ্ঠ কারণ বিশ্লেষণকে আড়াল করে এসে দাঁড়ায় খগেন মুর্মু-ত্রিপুরা-রাজভবন-রাষ্ট্রপতি ভবন-৩৫৫ বা ৩৫৬রা।
উত্তরবঙ্গবাসী কি পারবে এই মিডিয়া-তৃণমূল-বিজেপিকে এড়িয়ে, এই ইকোসিস্টেমের বানানো জগা খিচুড়িতে পেট না ভরিয়ে, পারসেপ্সন বিল্ডিং এর এই অপচেষ্টাকে সবাই মিলে একজোট হয়ে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে নিজেদের দরকারি একগুচ্ছ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে।

আমাদের মনে হচ্ছে পারবে।
কারণ এবার আর শুধু পাতের ভাত নয় তাদের মাথার ছাদটাও গেছে। তারা আজ সব খুইয়ে সহায় সম্বলহীন, আক্ষরিক অর্থেই সর্বহারা।
তাই উত্তর খুঁজতে ‘উত্তরবঙ্গ’ আজ মরিয়া।
ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস