সঞ্চার সাথী – ‘সনাতনী’ পেগাসাস / Sanchar Sathi

ভারতের টেলিকম দপ্তর সম্প্রতি এক নির্দেশ জারি করেছে, যাতে প্রত্যেক স্মার্টফোন প্রস্তুতকারককে “Sanchar Saathi” অ্যাপ প্রি-ইনস্টল করে দিতে হবে এবং এমনভাবে দিতে হবে যাতে ব্যবহারকারী সেটি ডিলিট বা নিষ্ক্রিয় করতে পারবেন না। এটা শুধু প্রযুক্তিগত দিক থেকে অগ্রহণযোগ্য নয়, সংবিধানের মৌলিক কাঠামো, আইনের শাসন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মৌলিক ধারণাকেই আঘাত করে। রাষ্ট্র যেন নাগরিকের ব্যক্তিগত মোবাইলেও জোর করে জায়গা দখল করতে চাইছে। সরকারের এই নির্দেশ কার্যত একটি প্রশাসনিক ফতোয়া, যার কোনো আইনগত ভিত্তি নেই; বরং সংবিধানের একাধিক ধারার স্পষ্ট লঙ্ঘন।
প্রথমত, নাগরিকের গোপনীয়তার অধিকার (Right to Privacy) যা ২০১৭ সালের Puttaswamy vs Union of India রায়ে সুপ্রিম কোর্ট একে Article 21-এর অধীন মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, সেটা এই নির্দেশের দ্বারা সরাসরি আক্রান্ত। আদালত স্পষ্ট বলেছে, রাষ্ট্র কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত ডিভাইস ও ডিজিটাল স্পেসে হস্তক্ষেপ করতে পারে কেবল তিনটি শর্ত পূরণ হলে: (১) বৈধ আইন, (২) ন্যায্য উদ্দেশ্য, (৩) অনুপাত বজায় রেখে ন্যূনতম হস্তক্ষেপ। “Sanchar Saathi” বাধ্যতামূলক করার ক্ষেত্রে এই তিনটির কোনোটিই নেই। আইন নেই, উদ্দেশ্য অস্পষ্ট, এবং হস্তক্ষেপ সর্বোচ্চ মাত্রার। প্রশাসনিক সার্কুলার কোনোভাবেই আইনকে প্রতিস্থাপন করতে পারে না। এই মৌলিক নীতিকে DoT যেন ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করছে।
দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্র যে একজন নাগরিকের টাকায় পরিচালিত হয় সেই নাগরিকের স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকারকে জোর করে খর্ব করছে, এটি Article 14-এর সমতার অধিকার ভঙ্গ করার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। একজন ব্যক্তি নিজের টাকায় একটি মোবাইল কিনবে, আর সরকার তার অনুমতি ছাড়াই সেখানে নিজেদের অ্যাপ ঢুকিয়ে বসে থাকবে, এটি ক্ষমতার অপব্যবহার ছাড়া আর কিছু নয়। এটা এমন যেন আপনি নিজের ঘরে ছিটকানি দিয়েছেন, আর সরকার এসে বলছে: এই ছিটকানি আমরা খুলব, কারণ আমরা আপনার গোপনীয়তার অংশীদার হতে চাই। এই মনোভাবে ‘দেশ’ আর ‘নাগরিক’-এর মাঝে সম্পর্কটি যেন আবার ঔপনিবেশিক যুগের মতো হয়ে উঠছে।
তৃতীয়ত, Consumer Protection Act, 2019 অনুযায়ী, ব্যবহারকারীর নিজের পয়সায় কেনা ডিভাইসের software environment তার ব্যক্তিগত সম্মতি ছাড়া পরিবর্তন করা, undeletable অ্যাপ প্রবেশ করানো, অথবা পারফরম্যান্স/গোপনীয়তা/স্বাধীনতায় প্রভাব ফেলা সবই “unfair trade practice”-এর আওতায় পড়ে। রাষ্ট্র নিজেই যদি unfair trade practice চালায়, তাহলে নাগরিক কার কাছে যাবে? এটি এমন এক অবস্থা যেখানে সরকার নিজেকে আইনসম্মত ক্ষমতার সীমার বাইরে দাঁড় করাচ্ছে।
চতুর্থত, এই নির্দেশ arbitrary executive action যা Article 14-এর “non-arbitrariness doctrine” এর বিরুদ্ধে যায়। একটি সিদ্ধান্ত যুক্তি, যৌক্তিকতা এবং আইনি ভিত্তির উপর নির্ভর করবে, এটাই আইনের শাসনের মৌলিক কথা। কিন্তু এখানে সরকারের যুক্তি এত দুর্বল, অগোছালো এবং অস্পষ্ট। মনে হয় যেন এটি প্রযুক্তিগত বিবেচনার বদলে নজরদারি সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে। এতে নাগরিক স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত ডিজিটাল নিরাপত্তা দুটিই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সবশেষে, রাষ্ট্রের এই আচরণ সংবিধানসম্মত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। নাগরিকের অনুমতি ছাড়াই তার ব্যক্তিগত ডিভাইসে সফটওয়্যার গেড়ে বসানো—এমন কাজ গণতন্ত্রে অকল্পনীয়। এটি এমন এক নজির, যা মেনে নেওয়া হলে ভবিষ্যতে রাষ্ট্র আরও intrusive technology নাগরিকের ফোনে, কম্পিউটারে, বা স্মার্ট ডিভাইসে ঢোকাতে উৎসাহ পাবে। এটি কেবল একটি অ্যাপ নয়, এটি নাগরিক অধিকার হরণের বিপজ্জনক পূর্বাভাস।
সুতরাং, বাধ্যতামূলক “Sanchar Saathi” প্রি-ইনস্টলেশন নির্দেশ অবিলম্বে বাতিল হওয়া উচিত। এটি অসাংবিধানিক, অবৈধ, ইচ্ছাকৃত ক্ষমতার অপব্যবহার, এবং ভারতের ডিজিটাল ভবিষ্যতের জন্য একটি গুরুতর হুমকি। রাষ্ট্রের উচিত নাগরিকের স্বাধীনতাকে সম্মান করা। এই প্রবণতা যদি এখনই থামানো না যায়, তাহলে ভারতার একটি পূর্ন ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত হতে খুব বেশি সময় লাগবে না।
ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস



