পরিযায়ী বাঙালি / Migrant Bengalis

তিনদিনের বিশেষ এক কাজে হায়দ্রাবাদ এসেছি। রবিবার ছুটির দুপুরে গিয়েছিলাম চারমিনার দর্শনে। রাস্তার ধারে পাইস হোটেলে অর্ডার দিলাম চিকেন বিরিয়ানির। দুপুর রোদে ঘুরে গলাটা বেশ শুকিয়ে গিয়েছিল, সাথে থাকা বোতলটা থেকে ঢকঢক করে পুরো জলটা খেয়ে ফেললাম। অবশেষে এলো বিরিয়ানি। যিনি নিয়ে এলেন তিনি পরিষ্কার বাংলা ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন, “ফাঁকা বোতলটা ফেলে দেব দাদা”। তৎক্ষণাৎ মুখ থেকে বেরোল, “আরে, আপনি তো আমাদের লোক।” ভদ্রলোকের বাড়ি পশ্চিম মেদিনপুরের খাকুরদা, কাঁথির কাছে। উনি হায়দ্রাবাদের বিরিয়ানির পাইস হোটেলে খাওয়ার সার্ভ করেন, টেবিল মোছেন, থালা বাটি মাজেন। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় ওনার জন্যে কাজ নেই, কলকাতাতেও নেই, তাই হয়তো তিনি আজ হায়দ্রাবাদের এই পাইস হোটেলে ৩ বছর ধরে কাজ করে মেদিনীপুরের সংসার চালাচ্ছেন।

বাঙালি একটা জাতি, যে জাতি প্রথম স্কুল বানিয়েছিল, ফুটবল খেলেছিল, প্রথম প্রেস বানিয়েছিল, প্রথম ডাক্তার হয়েছিল, প্রথম বিদ্রোহ লিখেছিল, প্রথম গান গেয়েছিল, সে জাতি আজ ট্রেনে-বাসে-ট্রাকে গাদাগাদি করে তেলেঙ্গানা,গুজরাট, দিল্লি, পাঞ্জাব, কেরল, মহারাষ্ট্রের চৌকিদার-ওয়েটার-মজুর হতে যাচ্ছে। বাংলার পেট চলে ভিনরাজ্যের ধুলো গিলে, এটো বাসন ধুয়ে, অথবা এসি অফিসে কম্পিউটারের সামনে বসে! এটাই কি সেই বাঙালি?

২০১১ সালে যখন এই রাজ্যে ক্ষমতার পালা বদল হল, সবাই বলেছিল পরিবর্তন হবে। পরিবর্তন হয়েছে বটে, কিন্তু তা কাজ হারানোর, কারখানা ফাঁকা হওয়ার, লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়েদের টিকিট কেটে ভিনরাজ্যে পালানোর পরিবর্তন!

২০১১ সালে ৬ লক্ষ থেকে আজ প্রায় ২ কোটি বাঙালি পরিযায়ী, কার গালে চড় এটা? বিহারীদের? গুজরাটিদের? কন্নড়দের? হিন্দুদের? মুসলিমের? নাকি বাঙালির? এই বাংলাই হৈ হট্টগোল করে একদিন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের নামে কারখানা তাড়িয়েছিল? সেই বাংলাই আজ ৬৬৮৮টি কারখানা বন্ধ হওয়ার পরও নিশ্চিন্ত।

তাই আজ প্রশ্ন করলে দোষ!

মিডিয়াতে বলে দেওয়া হয়েছে, প্রশ্ন করলেই বিজেপি চলে আসবে! তাই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে সরাসরি কোনো প্রশ্ন করা যাবে না! এমন কি রাজ্যের বিরোধী দলনেতাকেও এই নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করা যাবে না। ওনারা যা বলবেন সেটাই নোট নিয়ে ব্রেকিং বিষয় নিয়ে বার বার করে বলে মানুষের মন বিষিয়ে দিতে হবে। প্রচার বাঙালি বিরোধী হলেও চলবে, কিন্তু টিআরপির ইমানদণ্ডের ধ্বজভঙ্গ না হলেই হল।

আজ বাঙালি নিজেই পরিযায়ী। বাংলার ছেলেমেয়েরা ভিনরাজ্যে সস্তায় শ্রম দিচ্ছে, আর পশ্চিমবাংলার আসন গরম করছে গুজরাটের ক্রিকেটার, বিহারের অভিনেতা, মণিপুরের ব্যবসায়ী, আসামের প্রাক্তন মন্ত্রীর মেয়ে। বাংলার মাটি, বাংলার ভোট, অথচ বাঙালির প্রতিনিধি বাঙালি নয়! বাঙালি মেনে নিয়েছে।

একদিন মমতা ব্যানার্জী লোকসভায় কাগজ ছুঁড়ে বলেছিলেন, অনুপ্রবেশে ভরে গেছে পশ্চিমবঙ্গের ভোটার লিস্ট। আর আজকাল সেই অনুপ্রবেশই তাঁর ভোটব্যাঙ্ক!

যার চাকরি নেই, সে আজ গুজরাটে, রাজস্থানে, কেরলে বৃষ্টিতে-রোদে-রাতে খাটছে, অথচ এই রাজ্যের শাসকের কাছে সেটার জবাবদিহি চাওয়া হচ্ছে না! কেন? কারণ, আপনি চাইছেন না। আপনি লোকসভা বিধানসভায় যে প্রতিনিধিদের পাঠান, তাদের কাজ খালি একে অপরকে চোর বলা। আজ আপনাদের জন্যেই দল পাল্টালেও নেতারা জানেন, তারা যাই করুক, আপনি তাদের পায়ের তলায় পড়ে থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য ব্যোধ করেন।

ইতিহাসের সবথেকে লজ্জার অধ্যায় হচ্ছে এই নির্বোধ সহমতি। না কোনো প্রশ্ন কোরো না!

কিন্তু কী আছে হারানোর?

একটা জাতি যদি নিজের ছেলে-মেয়েদের জন্য কারখানা রাখতে না পারে, স্কুল রাখতে না পারে, ডাক্তারখানা রাখতে না পারে, তার রাজনীতি বাঁচিয়ে কী হবে? সেই জাতিকে বাঁচিয়ে কি হবে?

একটা জাতি যদি নিজের জমি, নিজের কাজ, নিজের ভাষা রক্ষায় কথা না বলে, তার বুদ্ধিজীবীর কলম-জোট-সভা সব ভুয়া!

আজ বাংলা রেনেসাঁ নয়, প্রতিবাদের অভাবে মৃত্যুযন্ত্রণায় আছে।
যে বাংলায় একদিন বিদ্যাসাগর, নজরুল, বিবেকানন্দ, রবি ঠাকুর, সুকান্ত জন্মেছিলেন, সেই বাংলায় আজ কোটি কোটি ছেলেমেয়ে পরিযায়ী, আর বাকি যারা আছে, তারা আরামকেদারায় বসে ফেসবুক টুইটার, ইউটিউবে বলে , ‘‘এবার ভোটে বিজেপি আসবেই আসবে!’’

যেখানে রুজি নেই, রুটি নেই, আইনের শাসন নেই, সেখানে বিজেপি কী, তৃণমূল কী?

যেখানে ছেলেমেয়েরা ঘর ছাড়া, সেখানে মুখ্যমন্ত্রী আর বিরোধী দলনেতার অজুহাত শোনার সময় কাদের আছে?

বাঙালি যদি নিজের হাতে নিজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে হারিয়ে দিতে চায়, দেউলিয়া হতে চায়, তাহলে হোক।
কিন্তু আর কোনো মায়া-রঙের পোস্টার, আর কোনো চাটুকারিতা, আর কোনো এলিট সিলেক্ট ক্লাব দিয়ে এই লজ্জা আর ঢেকে রাখা যাবে না।

এবার বাংলার মাটি থেকে হোক নতুন প্রশ্ন: কেন?

  • কাদের জন্য কোটি কোটি বাঙালি ঘরছাড়া?
  • কাদের জন্য ৬৬৮৮টি কারখানা বন্ধ?
  • কাদের জন্য ভিনরাজ্যের ভারতবাসীরা ধরে ধরে বাঙালিদের মারছে?

প্রশ্ন হোক। জ্বালা হোক। জবাব ছাড়া কেউ আর বাঁচতে পাবে না।

তাই যতদিন না প্রশ্ন জাগছে, বাংলার ঘরে থাকবে শুধু পরিবারের পরিযায়ী লোকটির ফাঁকা থালা আর কয়েকটি অব্যবহৃত পাসপোর্ট সাইজের ছবি।

ধন্যবাদান্তে,
এক এলিট ছোটলোক