আত্মবিস্মৃত / The Empty Chair at the Bengal Congress

বাংলার রাজনীতি আজ এমন এক নাট্যমঞ্চে পৌঁছেছে, যেখানে প্রধান চরিত্ররা নিজেরাই ভুলে গেছেন, গল্পটা আসলে কোথা থেকে শুরু হয়েছিল। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছিলেন, “আমরা ২৯৪ আসনে লড়ব।” বক্তব্যটি যতটা উচ্চকণ্ঠে, ততটাই ফাঁপা। কারণ কয়েক দিনের মধ্যেই দেখা গেল, দলের আসল সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন অন্য কেউ। অধীর চৌধুরী বিমান বসুর পাশে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন, “বাম–কংগ্রেস জোটই বাংলার ভবিষ্যৎ।”

সভাপতি চুপ। একটি রাজনৈতিক দলের সভাপতির নীরবতা কখনও কৌশল হতে পারে, কিন্তু এ নীরবতা আসলে আত্মসমর্পণ। এটি নেতৃত্ব নয়, একটি নামমাত্র প্রতীক – যেন কংগ্রেসের প্রদেশ সভাপতি আজ এক কাগজের চেয়ার।

রাজনীতির ইতিহাসে আত্মবিশ্বাস ও বাস্তবতার সংঘর্ষ নতুন নয়। কিন্তু যখন বক্তব্য বাস্তবের সঙ্গে মেলে না, তখন তা হাস্যকর হয়ে ওঠে। একটি দল, যার সংগঠন ভেঙে পড়েছে, মাঠে নেই স্থায়ী কর্মী, প্রার্থী পাওয়া দুষ্কর, সেই দল যদি ঘোষণা দেয় “২৯৪ আসনে লড়ব,” তবে সেটি রাজনীতি নয়, আত্মপ্রবঞ্চনা। দলীয় সূত্রই বলছে, সভাপতি সাহেবের একার সিদ্ধান্তে কিছুই হয় না। প্রার্থী নির্ধারণ থেকে জেলা নেতৃত্ব, সবকিছু ঠিক হয় অধীরবাবুর অনুমোদনে। অর্থাৎ সভাপতি শুধু বক্তা, নেতৃত্বের নাট্যকার অন্য কেউ। এই অবস্থায় সভাপতি পদটি আজ কেবল রাজনৈতিক ম্যানিকুইন, চেহারা আছে, প্রাণ নেই।

অধীর রঞ্জন চৌধুরী যে রাজ্য কংগ্রেসের প্রকৃত কর্তৃত্ব ধরে রেখেছেন, তাতে কারও সন্দেহ নেই। তিনি একদিকে দিল্লির রাজনীতিতে মুখ, অন্যদিকে রাজ্যের কংগ্রেসের কান, চোখ, হাত, সবই তাঁর নিয়ন্ত্রণে। সভাপতি কেবল মুখ।
এমন অবস্থায় প্রদেশ কংগ্রেস এখন কার্যত এক দ্বিমুখো প্রাণী, এক মাথায় বক্তৃতা, অন্য মাথায় সিদ্ধান্ত। এই দ্বৈততা শুধু দলের কর্মীদেরই নয়, বাম জোটের সঙ্গীদেরও বিভ্রান্ত করছে। কারণ এখন প্রশ্ন একটাই:

কংগ্রেসের সঙ্গে জোট মানে কোন কংগ্রেসের সঙ্গে? অধীরের কংগ্রেস, না শুভঙ্করের কংগ্রেস?

বামফ্রন্টও আজ এক মৃত শরিক রাজনীতির শবদেহ বহন করতে করতে ক্লান্ত, যাকে আপাতত কংগ্রেসের ভেন্টিলেটরে রাখা হয়েছে। একসময় যে ফ্রন্ট আদর্শে দৃঢ় ছিল, যাদের নীতি ছিল, লড়াই করে বাঁচতে হবে। আর সেই বাঁচার জন্য এখন তারাই এখন কংগ্রেসের কাঁধে ভর দিচ্ছে। এই জোট আদর্শের নয়, সুবিধার। বামেদের কাছে এখন রাজনীতি মানে আসন-সংখ্যা, স্লোগান নয়; লড়াই মানে চুক্তি, আন্দোলন নয়।

এ জোটে আদর্শের উপস্থিতি নেই, আছে কেবল রাজনৈতিক কারবার। যেখানে একদল নেতৃত্বহীন, অন্যদল নিঃশেষপ্রায় – তাদের জোটে জনগণের বিশ্বাস জন্মাবে কেন?

রাজনীতিতে নেতৃত্ব মানে সিদ্ধান্ত নেওয়া, কাজ করানো, এবং তার দায় নেওয়া। কিন্তু আজকের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির ভূমিকা সেই দায়িত্ব থেকে বহু দূরে। তিনি বক্তৃতা দেন, সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দেন, তারপর নীরব হয়ে যান।
এই নীরবতা কখনও বিনয় নয়, এটা অক্ষমতার পোশাক। যে সভাপতির কথা দল শোনে না, তাঁর পদে থেকে লাভ কী? এখন প্রদেশ কংগ্রেসের অবস্থা গর্জন আছে, কামড় নেই।

বাংলার বাম–কংগ্রেস জোট আজ এক রাজনৈতিক রসিকতা। দু’পক্ষের কেউই বেঁচে নেই, তবুও বিয়ের ফটোশুট চলছে! বামফ্রন্টের অস্তিত্ব টিকছে নামমাত্রে, কংগ্রেসের সংগঠনও হিমশীতল। দু’জনে মিলে একে অন্যের কাঁধে অক্সিজেন সিলিন্ডার বেঁধে রেখেছে, কিন্তু শ্বাস নিচ্ছে কে, তা কেউ জানে না। এই জোটের উদ্দেশ্য গণতন্ত্র নয়, এটি কেবল রাজনৈতিক রক্তসঞ্চার। বামেরা ভর দিচ্ছে কংগ্রেসে, কংগ্রেস ভর দিচ্ছে বামফ্রন্টে,।

ফল: দু’জনেই হাঁটছে, কিন্তু কেউ সুস্থ নয়।

একসময় বাংলার রাজনীতি আদর্শের লড়াইয়ে দাঁড়িয়েছিল। আজ তা পরিণত হয়েছে ব্যক্তির দম্ভে ও দলের রক্ষার কূটনীতিতে। যে কংগ্রেস একদা বামেদের বিরুদ্ধে লড়ত, আজ তারা বামেদের পাশে দাঁড়িয়ে নিজেদের প্রাসঙ্গিক রাখতে চাইছে। যে বামফ্রন্ট একদা কংগ্রেসকে সামন্তবাদী বলত, আজ তারা তাদের হাত ধরেছে। কারণ জনসমর্থন হারিয়ে গেছে, আর আর্তনাদই একমাত্র হাতিয়ার। এ দৃশ্য হাস্যকরও বটে, করুণও। কারণ রাজনীতি যখন টিকে থাকার জন্য আদর্শ বিক্রি করে, তখন জনগণের আস্থা ভেঙে যায়।

বাংলা রাজনীতির এই মুহূর্তে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ও বামফ্রন্ট দু’জনেই যেন এক নীরব থিয়েটারের চরিত্র। বক্তৃতা আছে, সংলাপ আছে, কিন্তু নেই কাহিনি।

সভাপতি বলছেন, “আমরা ২৯৪ আসনে লড়ব।”
অধীর ঠিক করছেন, কোথায় লড়বেন।
বিমান বসু বলছেন, “জোট হবে।”
আর মাঠে কর্মীরা ভাবছে – এই জোটে তাদের জায়গা কোথায়?

বাংলার মানুষ রাজনীতি চায়, নাটক নয়। তারা নেতৃত্ব চায়, মুখোশ নয়। তারা সিদ্ধান্ত চায়, ঘোষণা নয়।

যদি কংগ্রেস–বামফ্রন্টের নেতৃত্ব আজও এই সহজ সত্যটা না বোঝে, তবে ইতিহাস তাদের আর একবার লিখবে না, বরং কেবল ফুটনোটে লিখে দেবে: “একদল ছিল, যারা নিজেদেরই গুরুত্ব বুঝতে পারেনি।”