দেউচা-পাঁচামি কয়লাখনি প্রকল্প – একটি পর্যালোচনা / Deucha-Panchami

দেউচা পাঁচামি কয়লাখনি প্রকল্প এবং তার জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া নিয়ে গত প্রায় মাস খানেক ধরে রাজ্য সরকার তথা স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের সাথে এলাকার বসবাসকারী আদিবাসী সম্প্রদায়ের ব্যপক টানা পোড়েন শুরু হয়েছে। বেশ কয়েকটি বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। শাসক ও বিরোধী রাজনৈতিক দল গুলির বিরুদ্ধে এলাকাজুড়ে যথাক্রমে প্রকল্পের স্বপক্ষে ও বিপক্ষে জনমত তৈরির এবং প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ উঠছে। ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলিতে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক জমায়েত হয়েওছে । চলছে মিটিং-মিছিল। আদিবাসী সমাজ একত্রিত হতে শুরু করেছেন প্রকল্পের বিরুদ্ধে। এরইমধ্যে সম্প্রতি স্থানীয় প্রশাসন এলাকায় শান্তি বজায় রাখবার জন্য বাইরের থেকে কোন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের আর ঐ এলাকায় যেতে না দেওয়ার ফলে বিতর্কটি অন্য মাত্রা পেয়েছে ।

মূলস্রোতের সংবাদ মাধ্যম গুলো এনিয়ে তেমন কোন উচ্চবাচ্চ করছে না। পত্রপত্রিকায় তেমন লেখালেখিও হচ্ছে না দেউচা-পাঁচামি নিয়ে। ফলে জনমানসে এই প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা ঘিরে তৈরি হচ্ছে নানা ধরণের বিভ্রান্তি। বিকল্প সমাজ মাধ্যম গুলিতে চলছে রাজনৈতিক তরজা এবং সস্তা প্রচার। দেউচা-পাঁচামি প্রকল্পের বাস্তব প্রয়োজনীয়তা এবং তার রুপায়ণে যে সমস্ত প্রযুক্তিগত ও পরিবেশগত অন্তরায় রয়েছে তা নিয়ে তেমন কোন বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা চোখে পড়ছে না । এমনকি এত বড়মাপের একটি প্রকল্পের বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট এলাকার যে ধরণের আর্থ-সামাজিক রুপান্তর ঘটে তার যথাযথ বিশ্লেষণও আমাদের সামনে আসছে না। তাই আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস বাংলার খুঁটিনাটিতে এই দেউচা-পাঁচামি কয়লা খনি প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করতে বসেছি। এর সব তথ্যই আমরা সংগ্রহ করেছি বিভিন্ন অনলাইন/ অফলাইন সংবাদ মাধ্যম এবং মাইনিং সংক্রান্ত ওয়েবসাইট থেকে। লেখার শেষে তথ্যসূত্র দেওয়া থাকবে যা আপনারা নিজেরা পড়ে দেখে নিতে পারেন।

দেউচা-পাঁচামি কয়লাখনি প্রকল্প ঠিক কতটা বড়!

বীরভূম জেলার মহম্মদবাজার ব্লকের অন্তর্গত দেউচা-পাঁচামি-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণশিঙা কয়লাখনি প্রকল্পটি ১২.৩১ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত। এর মধ্যে রয়েছে দুইটি কোল ব্লক। দেউচা-পাঁচামি কোল ব্লক (৯.৪৮ বর্গ কিলোমিটার) এবং দেওয়ানগঞ্জ-হরিণশিঙা কোল ব্লক (২.৮৩ বর্গ কিলোমিটার)। জমির পরিমাণ হিসেব করলে প্রায় ৩৩০০ একর। প্রাথমিক জিওলজিক্যাল রিপোর্ট অনুযায়ী এখানে কয়লা আকরিকের মোট ৪ টি স্তর আছে যার সম্মিলিত গভীরতা ৮৫০ মিটার। কিন্তু সেই কয়লা আকরিকের স্তরের ওপরে রয়েছে একটি কমবেশি ১৫০ মিটার পুরু শক্ত কালো ব্যাসল্ট পাথরের স্তর। হিসেব অনুযায়ী এই খনি অঞ্চলে ২১০ কোটি টন কয়লা মজুত আছে এবং সেই হিসেবে এটি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং এশিয়ার বৃহত্তম কয়লাখনি। এছাড়াও কয়লা উত্তোলনের পূর্বে যে বাসল্ট পাথরেরও স্তর আছে তারও বাণিজ্যিক ব্যবহার ও উপযোগিতা রয়েছে যথেষ্ট। বস্তুত আমাদের বাংলার শহরাঞ্চলের সমস্ত গ্রানাইট পাথরের যে মেঝে বা ফ্লোর তৈরি হয় তার যোগান আসে এই বীরভূম অঞ্চলেরই পাথর খাদান থেকে। কাজেই ব্যাসল্ট পাথরের স্তরটিরও বিপুল বাণিজ্যিক সম্ভাবনা রয়েছে।

দেউচা-পাঁচামি ব্লক বন্টনের ইতিহাসটা ঠিক কি!

এই ইতিহাস হঠাৎ কেন বলছি তা একটু পড়লেই বুঝতে পারবেন। এখানেই আপনি প্রকল্পটির প্রযুক্তিগত জটিলতার ইঙ্গিত পাবেন যা নিয়ে তেমন কোন চর্চা কোথাও চোখে পড়ছে না।

কেন্দ্রীয় সরকার আজ থেকে প্রায় ১১ বছর আগে ২০১০ সালে দেউচা-পাঁচামি কয়লাক্ষেত্রটি আকরিক উত্তোলনের জন্য কোল ইন্ডিয়ার অধীনস্থ ইস্টার্ন কোলফিল্ডস লিমিটেডকে দেয়। কিন্তু কয়লাক্ষেত্রটির প্রাথমিক ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে তারা জানিয়ে দেয় ব্যাসল্ট পাথরের ১৫০ মিটার পুরু স্তর যাকে বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় রাজমহল ট্র্যাপ বলা হয় তা ভেদ করে ভূ-গর্ভ থেকে কয়লা উত্তোলনের প্রযুক্তি তাদের হাতে নেই। ফলে এই আকরিক সেই অর্থে উত্তোলন করা সম্ভব নয়। এর জন্য দেশের বাইরে থেকে আধুনিক প্রযুক্তি আমদানী করতে হবে এবং তারপরেও সমগ্র প্রকল্পটি অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ। ফলে অর্থনৈতিকভাবে প্রকল্পটিকে লাভজনক করতে বছরে প্রায় ৪০-৫০ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলনের প্রয়োজন।

কোল ইন্ডিয়া প্রকল্প থেকে সরে যেতে প্রকল্পের বিপুল ব্যয়ভারের কারণে কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৩ সালে প্রকল্পের সাথে পশ্চিমবঙ্গ সহ আরও ৬ টি রাজ্যকে (মানে পাঞ্জাব, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কর্নাটক এবং পশ্চিমবঙ্গ) এবং সাতলাজ জলবিদ্যুৎ নিগম লিমিটেড নামক একটি জলবিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কেন্দ্রীয় সংস্থাকে যুক্ত করে এবং ঠিক হয় উত্তোলিত কয়লা এই রাজ্যগুলি এবং ঐ সংস্থাটি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবে। খনিটি পশ্চিমবঙ্গে হওয়ায় ২৮% কয়লা পাবে রাজ্য। লাগোয়া রাজ্য বিহার পাবে ২৩%। বাকিরাও তাদের প্রাপ্য অনুযায়ী বাকি কয়লার ভাগ পাবে। তৈরি হয় বেঙ্গল বীরভূম কোলফিল্ডস লিমিটেড। কিন্তু প্রযুক্তিগত জটিলতা এবং বিপুল খরচের বহর দেখে খরচের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়েই ঝামেলা শুরু হয়ে যায় রাজ্য গুলির মধ্যে। একে একে সবাই হাত উঠিয়ে নেয়। শেষমেশ ২০১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার একাই সমস্ত প্রকল্পের দায়িত্ব নিতে চেয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন জানায়। সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় সরকার দেউচা-পাঁচামি-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণশিঙা কয়লা ক্ষেত্রটি ওয়েস্ট বেঙ্গল পাওয়ার ডেভেলাপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেডকে (WBPDCL) বন্টন করে।

দেউচা-পাঁচামি প্রকল্পে কিভাবে এই বিপুল পরিমাণ কয়লা উত্তোলন করা হবে!

খনি থেকে খনিজ উত্তোলনের জন্য সাধারণ ভাষায় বোঝাতে গেলে তিনরকমের পদ্ধতি আছে। আন্ডারগ্রাউন্ড মাইনিং, আন্ডার ওয়াটার মাইনিং এবং সারফেস মাইনিং। প্রথম ক্ষেত্রে টানেলিং মাধ্যমে (সমান্তরাল বা লম্বালম্বি) মাটির নীচ থেকে খনিজ তোলা হয়। এটি মূলত ব্যবহার করা হয় যখন খনিজস্তর ভূ-পৃষ্ঠ থেকে অনেক গভীরে থাকে এবং এটি অত্যন্ত ব্যয় সাপেক্ষ। এতে ঝুঁকিও অনেক বেশি। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে মূলত সমুদ্রগর্ভ থেকে খনিজ তুলে আনা হয়। আর সারফেস মাইনিং ব্যবহার করা হয় যখন খনিজস্তর ভূপৃষ্ঠ থেকে কম গভীরে থাকে। এই সারফেস মাইনিং এর একটি প্রকার হল ওপেন কাস্ট মাইনিং বা খোলামুখ খনিজ খনন প্রক্রিয়া যেটা আমাদের দেউচা-পাঁচামি প্রকল্পে ব্যবহার করা হবে।

এই পদ্ধতিতে ড্রিলিং , ব্লাস্টিং এবং বুলডোজিং এর মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠ খুঁড়ে ধাপে ধাপে ( অনেকটা সিড়ির মত যাকে খনিজ প্রযুক্তিবিদ্যার পরিভাষায় “বেঞ্চ” বলা হয়) নীচে নেমে খনিজ তুলে আনা হয়। আর এই পদ্ধতিতে মাটি খুঁড়ে খনিজ স্তরে পৌছানোর আগে প্রচুর পরিমাণে ভূ-মৃত্তিকা ( মাটি পাথর ধাতু ইত্যাদি দিয়ে তৈরি ভূপৃষ্ঠের স্তর) ওঠে যাকে বলা হয় ওভারবার্ডেন। একে ডাম্প বা মজুত করা হয় মূল খনি প্রকল্পের এরিয়ার বাইরে নির্দিষ্ট ডাম্প ইয়ার্ডে। খনন ও খনিজ উত্তোলন প্রক্রিয়ার শেষে গর্ত ভরতি করবার জন্য ঐ ওভারবার্ডেন ব্যবহার করা হয় যাকে বলা হয় ব্যাকফিলিং। কেউ কেউ আবার বলেন রেক্লেমেশান।

আমাদের দেউচা পাঁচামি প্রকল্পেও এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে। তাই টেকনিকাল দু একটা কথা এখানে জানিয়ে রাখা হল যাতে পরবর্তী পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের সময় বুঝতে সুবিধে হয়।

প্রকল্পে ঠিক কতখানি জমি লাগবে!

মূল খনি অঞ্চল আগেই জানানো হয়েছে ১২.৩১ বর্গ কিলোমিটার বা কমবেশি ৩৩০০ একর। এর বাইরে রয়েছে ওভারবার্ডেন ডাম্পিং ইয়ার্ড, বাফার জোন এবং পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় জমি। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম সূত্রে যা জানা যাচ্ছে সব কিছু যোগ করলে মোট ১১,২২৩ একর জমি লাগবে। এরমধ্যে সরকারী জমি মাত্র ২০০০ একর। মানে বাকি ৯০০০ একরের বেশি জমি সরকারকে অধিগ্রহণ করতে হবে। এর মধ্যে একটা অংশ আবার বনাঞ্চল বা অরণ্য। বাকি প্রায় পুরো জমিটাই স্থানীয় অধিবাসীদের যার একটা বড় অংশ আদিবাসী ।

ঠিক কতজন মানুষ এই প্রকল্পের কারণে বাড়িছাড়া হবেন বা কাজ হারাবেন!

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সূত্রে যা তথ্য আমাদের সামনে এসেছে তাতে ১৯ টি গ্রামের ৪৩০০ টির মত পরিবারের ২১০০০ এর মত মানুষ এই প্রকল্পের কারণে বাস্তুচ্যুত হতে চলেছেন বলে মনে করা হচ্ছে। আর রয়েছে ২৭ টি পাথর খাদান এবং ২৮৫ টি স্টোন ক্রাশার ইউনিট যেখানে কমবেশি ৩০০০ মানুষ কাজ করেন। এছাড়া আছেন ১৬০ জন ক্ষেত মজুর যারা জমি চলে যাওয়ায় কাজ হারাবেন। তবে সরাসরি না হলেও এই খোলামুখ খনি প্রকল্পের প্রভাব পড়বে প্রায় ৫৩ টি জনপদের ৭০,০০০ মানুষের জীবনে।

সরকারের তরফে ঘোষিত ক্ষতি পূরণ এবং পুনর্বাসন প্যাকেজে ঠিক কি কি আছে!

বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা এবং অনলাইন পোর্টাল থেকে আমরা সরকার ঘোষিত যে ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসন প্যাকেজের তালিকা পেয়েছি তা নীচে দেওয়া হল।   

  • জমিহারা প্রত্যেকে বিঘা প্রতি ১০ লক্ষ – ১৩ লক্ষ টাকা পাবে।
  • পুনর্বাসনের জন্য তৈরি করা হবে আলাদা কলোনী। সেখানে প্রত্যেক পরিবারকে দেওয়া হবে ৬০০ বর্গফুটের বাড়ি।
  • কলোনীতে স্থানান্তরের জন্য দেওয়া হবে পরিবার পিছু ৫.৫০ লক্ষ টাকা।
  • কলোনীতে রাস্তা, পানীয় জল, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ফেয়ার প্রাইসশপ, অঙ্গনয়াড়ি কেন্দ্র, ব্যাঙ্ক, খেলার মাঠ, কমিউনিটি সেন্টার, পূজোর জায়গা এবং মৃতদেহ সৎকার/কবরের জমির ব্যবস্থা থাকবে। বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা থাকবে কি না আমরা জানতে পারি নি। তবে আশা করবো সরকারের তরফে নিশ্চয়ই এব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।     
  • প্রতিটি জমিহারা/বাস্তুচ্যুত পরিবার পিছু একজনকে জুনিয়র কনস্টেবল পদে রাজ্য পুলিশে চাকরি দেওয়া হবে। এমনকি যারা ভাগচাষী বা লিজে জমি চাষ করেন তাদের পরিবার পিছু একজনও এই চাকরীর সুবিধা পাবেন। সূত্রের খবর প্রাথমিক পরিসংখ্যানে ৪৯৪২ জনকে এই চাকরি দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে।   
  • পাথর খাদান এবং স্টোন ক্রাশার ইউনিটে কাজ করেন এমন ৩০০০ জন কে এক বছর প্রতিমাসে ১০,০০০ টাকা করে মাসোহারা দেওয়া হবে।
  • চাষের জমির সাথে যুক্ত ক্ষেতমজুরদের এককালীন ৫০,০০০ হাজার টাকা এবং রেগার অধীনে ৫০০ দিন পর্যন্ত কাজ পাওয়া নিশ্চিত করা হবে।
  • ২৮৫ টি স্টোন ক্রাশার ইউনিটের মালিকেরা তাদের বাড়ি ও জমির দাম ছাড়াও পাবেন প্রস্তাবিত ব্যাসল্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে পুনর্বাসন। স্থানান্তরের খরচ হিসেবে একাকালীন ৫০ হাজার টাকা করে তাদেরকে অতিরিক্র দেওয়া হবে। আর ৬ মাস ধরে ফ্রিতে প্রতিদিন দেওয়া হবে ১০ ট্রাক ব্যাসল্ট পাথর। এখানে বলে রাখা ভালো প্রস্তাবিত কয়লা খনি প্রকল্পে শুরুর কয়েক বছর কমবেশি ১৫০ মিটার গভীর ব্যাসল্টের স্তর খননের ফলে উঠবে প্রচুর ব্যাসল্ট পাথর যাকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট এলাকায় একটি ব্যাসল্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক গড়ে তোলার প্রস্তাব রয়েছে।   
  • ২৭ টি পাথর খাদানের মালিকরাও পাবেন তাদের জমির ও বাড়ির দাম। ব্যাসল্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে কোনওভাবে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে কিনা সে ব্যাপারে কোন নির্দিষ্ট তথ্য আমরা যোগাড় করতে পারি নি।    

মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা করেছেন এই সম্পূর্ণ প্যাকেজটির জন্য খরচ হবে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। 

এই কয়লা কি কাজে লাগবে!

যে ধরণের বার্তা রাজ্য প্রশাসনের তরফ থেকে দেওয়া হচ্ছে তাতে সাধারণ মানুষের মনে হতেই পারে এই প্রস্তাবিত কয়লাখনি প্রকল্পের কয়লা মূলতঃ রাজ্যের তাপ বিদ্যুতকেন্দ্রগুলির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হবে। মানে এক কথায় দেউচা-পাঁচামি হল বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লা যোগানের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গকে আত্মনির্ভর করে তোলার সহজ আশু সমাধান। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন এই প্রকপ্ল বাস্তবায়িত হলে আগামী ১০০ বছরের জন্য রাজ্যকে আর বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভাবতে হবে না। সংবাদ মাধ্যম গুলির শিরোনামে উঠে আসছে এমনই সব ইতিবাচক কথা।

কিন্তু এপ্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞ মহলে কিছুটা হলেও অন্যরকম স্বর শোনা যাচ্ছে। এই যেমন কোল ইন্ডিয়া এই প্রকল্প থেকে হাত গুটিয়ে নেওয়ার পর সংস্থার প্রাক্তন চেয়ারম্যান পার্থ সারথি ভট্টাচার্য একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন এই প্রকল্পের বাস্তবায়নে যে পরিমাণ পুঁজির প্রয়োজন তাকে লাভজনক করতে প্রতিবছর ন্যুনতম ৩০-৪০ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করা প্রয়োজন। আর দেউচা-পাঁচামি খনি অঞ্চলের প্রাথমিক সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে জানাগেছে মোট ২১০ কোটি টন কয়লা মজুত আছে যার অর্থ যদি সব কয়লা উত্তোলন সম্ভবও হয় সেক্ষেত্রে কম বেশি ৪০-৫০ বছর খনন কার্য চলবে আর কয়লা যেহেতু বেশিদিন স্টোর করে রাখা সম্ভব নয় তাই লাভজনক উপায়ে খনন কার্য চালালে তার থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লার যোগানও পাওয়া যাবে ঐ ৪০-৫০ বছর এবং সেটা কখনই ১০০ বছর নয়।

এদিকে WBPDCL এর ওয়েবসাইট বলছে এই মুহুর্তে তাদের চালু তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলিতে কয়লার বাৎসরিক চাহিদা রয়েছে ২৪ মিলিয়ন টনের মত যা আগামীদিনের সম্প্রসারণের কথা মাথায় রাখলে পৌছবে ৪০ মিলিয়ন টনের আশপাশে। মানে দেউচা-পাঁচামি প্রকল্পের উত্তোলিত কয়লার প্রায় পুরোটাই চলে যাবে WBPDCL এর চাহিদা মেটাতে। সেক্ষেত্রে রাজ্যে CESC, NTPC অথবা DVC র বাকি যে তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র গুলি রয়েছে সেগুলির বাৎসরিক চাহিদার যোগান দেউচা-পাঁচামি দিতে পারবে না। WBPDCL এর চাহিদা মিটিয়ে যে সামান্য উদ্বৃত্ত থাকবে তা ইউরিয়া অ্যামোনিয়া ইত্যাদির বাণিজ্যিক উৎপাদনে ব্যবহৃত হবে। কাজেই দেউচা-পাঁচামি খনি প্রকল্প কোনভাবেই রাজ্যের আগামী ১০০ বছরের বিদ্যুৎ উৎপাদনের চাহিদা মতন কয়লার যোগান দিতে পারবে না।

এর পাশাপাশি আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য যে ধরণের প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা প্রয়োজন তা এই মুহুর্তে দেশের কোন সরকারী অথবা বেসরকারী সংস্থার নেই। এজন্য WBPDCL কে এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ কোন আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে গাঁটছড়া বাঁধতে হবে। মানে সোজাকথায় এই প্রকল্পের সাফল্যের সিংহভাগ নির্ভর করছে WBPDCL এর এই টেকনোলজি পার্টনারের ওপর।

প্রকল্পের টেকনোলজি পার্টনার কোথায়! রাজ্যের আংশীদারীত্বই বা কতখানি থাকবে!

বিভিন্ন সংবাদ সংস্থাসূত্রে যতটুকু যা খবর পাওয়া যাচ্ছে তা হল এখনও পর্যন্ত কোন অভিজ্ঞ আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে WBPDCL এর এবিষয়ে কথা তেমন এগোয় নি। প্রাথমিক খোঁজ খবর চলছে। অংশীদার সংস্থা ঠিক হলে তাদের বিশেষজ্ঞ দল এসে সরজেমিনে সমীক্ষা করবার পরই জানা যাবে সর্বমোট ঠিক কতটা কয়লা তোলা সম্ভব হবে, ঠিক কতটা জমি লাগবে বা প্রতি বছর কতটা কয়লা তুলতে হবে বা পারা যাবে প্রকল্পটিকে লাভজনক করবার জন্য। পাশাপাশি ঠিক কি পরিমাণ বিনিয়োগ লাগবে প্রকল্পটির বাস্তবায়নে অথবা কর্ম সংস্থানই বা হবে কতজনের তারও একটা স্পষ্ট ছবি পাওয়া যাবে।

শুধু তাই নয় ঠিক কি কি শর্তে ঐ সংস্থাটি প্রকল্পে অংশগ্রহণ করছে তাও জানা জরুরি। কারণ সরকারের তরফ থেকে যে বিপুল অঙ্কের টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে ধার্য করা হয়েছে তা আদতে জনগণের ট্যাক্সের টাকা এবং সেটিও একরকমের সরকারী বিনিয়োগ। কাজেই সেই বিনিয়োগের লাভ লোকসানের দিকটাও উপেক্ষা করা উচিৎ হবে না যেখানে রাজ্য সরকারের মাথায় এই মুহুর্তে রয়েছে ৫ লক্ষকোটি টাকার ঋণ। সাধারণ মানুষের করের টাকার বিনিময়ে হাজার হাজার আদিবাসী মানুষকে উচ্ছেদ করে ও পুনর্বাসন দিয়ে যদি দেখা যায়  এরপর কোন বিদেশি সংস্থা এসে বিপুল অঙ্কের লাভ নিয়ে চলে গেল তাতে রাজ্যের আখেরে কতটা লাভ হবে সেটাও আমাদের বিবেচনার মধ্যে রাখতে হবে।

এপ্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় মনে রাখা জরুরি। বর্তমানে কয়লা এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ বিদেশী বিনিয়োগের পথ খোলা রয়েছে। ফলে যদি প্রকল্পের টেকনোলজি পার্টনার বৃহৎ অংশের শেয়ারের অংশীদার হন এবং WBPDCL মাইনরিটি শেয়ারহোল্ডার হয় তবে সেক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহণের দায়ভার এই দুই কোম্পানির জয়েন্ট ভেঞ্চারের দায়িত্বে ছেড়ে দেওয়া উচিৎ। কারণ কোন বেসরকারী সংস্থার হয়ে সরকারের তরফে জমি অধিগ্রহণে নীতিগত এবং আইনগত অন্তরায় রয়েছে বর্তমান জমি অধিগ্রহণ আইনে যার মূল প্রবক্তা ছিলেন আমাদের রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী নিজেই।

তাই টেকনলজি পার্টনার ঠিক না করেই তার আগেই এই মুহুর্তে সরকারের তরফে জমি অধিগ্রহণের মধ্যে “Fait Accompli” র ছায়া ভবিষ্যতে যে পড়বে না তা নিশ্চিতকরে বলা যাচ্ছে না।

ঠিক কতজন মানুষের চাকরি হবে

সরকারের তরফে দাবি করা হচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষের চাকরি হবে। এক লক্ষ-দু লক্ষ ইত্যাদি নানা রকমের সংখ্যা ভাসছে বিভিন্ন সমাজ মাধ্যমে । আমরা এব্যাপারে বিশেষজ্ঞ নই। কাজেই বলতে পারবো না সরকারের দাবি সঠিক কি না! তবে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লাখনি প্রকল্পে কাজ শুরু হলে আমাদের বিশ্বাস বেশ ভালো সংখ্যক কর্মসংস্থান তৈরি হবে। তবে সেটা একলক্ষে পৌছাবে কি না তা সময়ই বলবে।

আমরা শুধু এব্যাপারে একটি তথ্য সামনে আনতে চাই। কোল ইন্ডিয়া লিমিটেড হল ভারতের বৃহত্তম কয়লা উৎপাদনকারী সংস্থা। ২০২০-২১ অর্থবর্ষে এদের বাৎসরিক কয়লা উত্তোলনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫৯৬ মিলিয়ন টনের মত । এই সংস্থায় গত অর্থবর্ষে ২ লক্ষ ৭২ হাজারের মত মানুষ কাজ করেছেন। সেই বিচারে প্রস্তাবিত দেউচা-পাঁচামি কয়লাখনি প্রকল্পে বাৎসরিক কয়লা উত্তোলনের লক্ষমাত্রা হতে পারে ৩০-৪০ মিলিয়ন টন। মানে কোল ইন্ডিয়ার ১৫ ভাগের একভাগ বা তার কম। আর মুখ্যমন্ত্রীর দাবি মতো যদি সরকার ১০০ বছরধরে কয়লা উত্তোলনের পরিকল্পনা করেন এবং তাতে তাদের টেকনোলজি পার্টনার সহমত হয় তাহলে সেক্ষেত্রে বাৎসরিক কয়লা উত্তোলনের লক্ষমাত্রা হবে ২০ মিলিয়ন টন যা কোল ইন্ডিয়ার বাৎসরিক কয়লা উৎপাদন ক্ষমতার ৩০ ভাগের এক ভাগ। কাজেই সেদিক দিয়ে বিচার করলে এই দেউচা পাঁচামি প্রকল্পে সরসারি কাজের সুযোগ পেতে পারেন কমবেশি দশ থেকে পনেরো হাজারের মত মানুষ। আর পরোক্ষ কর্মসংস্থান হতে পারে আরও সর্বোচ্চ বিশ হাজার মানুষের। এমনটাই অন্তত ধারণা বিশেষজ্ঞ মহলের।     

তাই আমাদের মনে হয়েছে কর্মসংস্থানের সুনির্দ্দিষ্ট পরিকল্পনাসহ কতজন শিক্ষিত দক্ষতা সম্পন্ন শ্রমিক এবং কতজন অদক্ষ জনমজুর বা স্বল্পদক্ষ শ্রমিক অথবা কতজন স্থানীয় মানুষ এই প্রকল্পে কাজ পাবেন এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থানের হিসেবটাই বা ঠিক কি রকম এইসব বিশদে তথ্যদিয়ে লক্ষাধিক চাকরির দাবী করা হলে সেটা আরও বেশি গ্রহণযোগ্য হত। কিন্তু বাংলার এই আকালের বাজারে তিরিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানও খুব একটা খারাপ নয়।    

এতটা পড়ে যারা ভাবছেন WBPDCL এর প্রস্তাবিত প্রকল্প নিয়ে “POWER TO PROSPER” প্রচারে গা ভাসাবেন তাদেরকে আরেকটা তথ্যর দিকে একটু চোখ বোলাতে অনুরোধ করবো। বিশেষত যারা ভাবছেন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লাখনি প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেই পশ্চিমবঙ্গের ভাগ্যের চাকা গড়্গড়িয়ে এগিয়ে যাবে তাদেরকে জানাই এমনটা নাও হতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ আমাদের হাতের সামনেই রয়েছে ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়, উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ এবং বিহারের মত রাজ্যগুলি যেখানে বিগত প্রায় কয়েক দশক ধরে খনি প্রকল্পের কাজ চলেছে এবং এখনও চলছে। শুধু কয়লা নয়, লোহা, তামা, বক্সাইট, কোয়ার্জ, লাইমস্টোন, গ্র্যানাইট ইত্যাদি যাবতীয় খনিজের ভান্ডার এই রাজ্যগুলি। অথচ অর্থনৈতিক বিকাশ অথবা সামাজিক উন্নয়নের নিরিখে এদের মধ্যে একটি রাজ্যও ভারতের অগ্রণীরাজ্য গুলির মধ্যে পড়ে না। এমনকি ঝাড়খণ্ডে ভারতের ৪০% খনিজ মজুত রয়েছে এবং তার মাইনিং চলছে কয়েক দশক ধরে। অথচ এটি এই মুহুর্তে দেশের পিছিয়ে থাকা রাজ্যগুলির মধ্যে একটি। কাজেই আমাদের অনুরোধ বিভ্রান্তিমূলক প্রচারে জড়িয়ে পড়বেন না। একটা খোলামুখ কয়লাখনি প্রকল্প দিয়ে সেটা পৃথিবীর দ্বিতীয় এবং এশিয়ার বৃহত্তম হলেও একটা রাজ্যের ভোল বদলে ফেলা যায় না যেখানে প্রায় দশ কোটির বেশি মানুষ বাস করেন। 

পরিবেশ দূষণের সমস্যা কতটা! 

এইবার আমরা ঢুকে পড়ছি দেউচা-পাঁচামি কয়লাখনি প্রকল্পের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিতর্কিত অংশে।

আগেই আমরা বলেছি এবং এই নিয়ে আলোচনাও করেছি যে দেউচা-পাঁচামি আদতে একটি ওপেন কাস্ট মাইন বা খোলামুখ কয়লা খনি প্রকল্প। প্রকল্পের প্রাথমিক পর্যায় মূলতঃ ড্রিলিং, ব্লাস্টিং বা বুল্ডোজিং এর মাধ্যমে ১৩৫-১৫০ মিটার পুরু ব্যাসল্ট পাথরের স্তর সরানো হবে যাকে কাঁচামাল হিসেবে ভিত্তি করে নিকটবর্তী অঞ্চলে একটি ইন্টিগ্রেটেড ব্যাসল্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক তৈরির প্রস্তাব রয়েছে।

এখন এই ড্রিলিং এবং ব্লাস্টিং এর ফলে মহম্মদবাজার ব্লক ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ব্যপক পরিমাণে শব্দ দূষণ এবং বায়ু দূষণ অবসম্ভাবী। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো এই অঞ্চলে এই মুহুর্তে যে পাথর খাদান এবং স্টোন ক্রাশিং ইউনিট গুলি রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে বায়ু এবং শব্দ দূষণের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। বাতাসে ধূলিকণা ও পাথরকণার আধিক্যের কারণে একটা বড় অংশের মানুষ নানারকম ফুসফুস সম্পর্কিত জটিল রোগ এমনকি সিলিকোসিসের মত মারণ রোগের শিকার হয়েছেন।

এমনকি ড্রিলিং এবং ব্লাস্টিং পদ্ধতিতে ব্যাসল্ট পাথরের স্তর ভাঙবার সময় অথবা কয়লাস্তর ভেঙ্গে আকরিক তোলবার সময় পার্শ্ববর্তী ভূ-স্তরে ফাটলও দেখা দিতে পারে এবং সেই ফাটল দিয়ে ব্যাসল্ট বা কয়লা স্তরে জমে থাকা বিষাক্ত খনিজ, গ্যাস অথবা তেজস্ক্রিয় পদার্থ পার্শ্ববর্তী এলাকার জলস্তরে মিশে গিয়ে সেখানকার ভূ-স্তর অথবা জলস্তরকে বিষিয়ে দেওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় অ্যাসিড মাইন ড্রেনেজ।

এছাড়াও প্রস্তাবিত প্রকল্পে যে বিপুল পরিমাণ ওভারবার্ডেন উৎপন্ন হবে তা ডাম্পিং ইয়ার্ডে উন্মুক্ত পরিবেশে পড়ে থাকবার কারণে তার থেকে বায়ুদূষণ ছাড়াও তেজস্ক্রিয় বিকিরণের কারণে অথবা জল-বাতাসের সংস্পর্শে এসে অ্যাসিড জনিত বিষক্রিয়ার ফলে এলাকার জল এবং মাটি দূষিত হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। বহু বিশেষজ্ঞের মতে এতবড় এলাকা জুড়ে ব্লাস্টিং, ড্রিলিং অথবা বুল্ডোজিং করলে আশপাশের এলাকার ভূমিক্ষয়ও অবধারিত।  

পরিশেষে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে জনমানসে তা হল যদি উত্তোলিত ব্যাসল্ট পাথরের স্তর কাঁচামাল হিসেবে ইন্টিগ্রেটেড ব্যাসল্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে ব্যবহৃত হয় তবে খনিজ খনন প্রক্রিয়ার শেষে ব্যাকফিলিং এর সময় ওভারবার্ডেন কম পড়বে ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকাটি লো ল্যান্ড এরিয়া বা নীচু জলাভূমিতে পরিণত হবে যা মহম্মদবাজার ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকার বাস্তুতন্ত্র বদলে দেবে। আর এমনিতেও শুধু আমাদের দেশে নয় এমনকি বিদেশেও খোলামুখ কয়নাখনি প্রকল্পে খনিজ খনন শেষে যথাযথ ব্যাকফিলিং না করেই এলাকা থেকে সরে আসার ভূরিভূরি অভিযোগ রয়েছে নামী-দামী সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে। তা নিয়ে মামলা-মকদ্দমাও ঝুলে আছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে। কাজেই এদিকটাও বিবেচনা করে দেখা প্রয়োজন।      

এ প্রসঙ্গে আমরা জানাই আমাদের কাছে এখনও পর্যন্ত যা খবর রয়েছে তা হল দেউচা পাঁচামি প্রকল্পটি কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ মন্ত্রকের ছাড়পত্র এখনও পায় নি। এমনকি এতবড় একটি প্রকল্পের এনভায়রনমেন্ট ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট নিয়েও জনমানসে ধোঁয়াশা রয়েছে। এই রিপোর্ট টি জনসমক্ষে আনা জরুরি এবং তার বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা হওয়া প্রয়োজন। যে সংস্থা এই রিপোর্ট বানিয়েছে তার যোগ্যতা অভিজ্ঞতা এবং নিয়োগ পদ্ধতিও সরজেমিনে ক্ষতিয়ে দেখা দরকার। প্রয়োজনে সর্বদলীয় কমিটি গঠন করে এর পর্যালোচনা হোক।

যেহেতু প্রস্তাবিত খোলামুখ কয়লাখনি প্রকল্পটিতে পরিবেশ দূষণের ব্যপকতা এবং অনিবার্যতা বেশি তাই পরিবেশ মন্ত্রকের ছাড়পত্র পাওয়ার আগেই এই প্রকল্পের কাজে অগ্রসর না হওয়াই বিধেয় বলে আমাদের মনে হয়েছে!  

বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষেত্রের রূপান্তরের সাথে দেউচা-পাঁচামি কতটা মানানসই!

আমাদের দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষেত্র ঠিক কোন পথে এগোচ্ছে সেটা বুঝতে হলে একটা ছোট্ট পরিসংখ্যান দিয়ে বিগত সাতআট বছরের যাত্রাপথটিকে দেখবার চেষ্টা করলেই একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে।

আজ থেকে প্রায় আট বছর আগে মানে ২০১৪ সালের মার্চ মাস নাগাদ সারা দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা ছিল ২ লক্ষ ৮৩ হাজার ২৯ মেগাওয়াট যার সিংহভাগ মানে প্রায় ৭০% এর মত আসতো তাপবিদ্যুৎ থেকে। ১৬% -১৭% আসত জল বিদ্যুৎ থেকে । অচিরাচরিত শক্তি মানে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, সৌরবিদ্যুৎ অথবা ক্ষুদ্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলির সম্মিলিত ভাগ ছিল ১২%। বাকি ১%-২% ছিল পারমাণবিক বিদ্যুৎ।

কিন্তু এখন শেষ তথ্য পাওয়া পর্যন্ত (৩০ নভেম্বর,২০২১) ভারতের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৩ লক্ষ ৯২ হাজার ১৭ মেগাওয়াট। এখন তাপবিদ্যুৎ মানে কয়লা প্রাকৃতিক গ্যাসের মত ফসিল ফুয়েল পুড়িয়ে আসে ৬০% বিদ্যুৎ। জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভাগ ১২%। অচিরাচরিত শক্তি মানে বায়ুচালিত বিদ্যুৎ, সৌরবিদ্যুৎ অথবা ক্ষুদ্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলির সম্মিলিত ভাগ বেড়ে হয়েছে ২৬% আর অবশিষ্ট ১%-২% আসে পারমাণবিক ক্ষেত্র থেকে।

ফলে অভিমূখ স্পষ্ট। তাপবিদ্যুৎ মানে ফসিল ফুয়েল জ্বালিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে জলবিদ্যুৎ বায়ুবিদ্যুৎ অথবা সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে বেশি জোর দিয়ে চাহিদা মেটানোর দিকে দেশ এগোচ্ছে। গত আট বছরে তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা যেখানে বেড়েছে ৬৫,০০০ মেগওয়াট সেখানে অচিরাচরিত শক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে ৭৫,০০০ মেগাওয়াট। জলবিদ্যুৎও বেড়েছে ৬০০০ মেগাওয়াট। ভবিষ্যতেও এই অভিমুখেই দেশের বিদ্যুৎক্ষেত্র এগোবে। যতদিন যাবে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা এবং আগ্রহ কমতে থাকবে এবং বায়ু ও সৌর বিদ্যুৎ অগ্রণী ভূমিকা নেবে। এরমধ্যে সৌরবিদ্যুৎ ক্ষেত্রের উত্থানের স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। যে ৭৫,০০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি হয়েছে গত সাত-আট বছরে তারমধ্যে ৪৫,০০০ মেগাওয়াট এসেছে এই সৌরবিদ্যুত থেকে। ২০,০০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি হয়েছে বায়ুচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষেত্রে। আর এই পরিবর্তনের একটা বড় কারণ হল পরিবেশ দূষণ। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত কয়লা এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের মত কার্বনযুক্ত পদার্থ গুলিকেই  পরিবেশ দূষণ ও বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য মূলতঃ দায়ী করা হয়। আর শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা পোড়ানোই নয় খনি থেকে সেই কয়লা উত্তোলনের ক্ষেত্রেও রয়েছে পরিবেশ দূষণের হাজারো সমস্যা। তাই এর বিকল্পের খোঁজ চলছে সারা পৃথিবীজুড়ে প্রযুক্তিবিদ গবেষকদের মধ্যে।   

ইতিমধ্যেই বায়ুবিদ্যুৎ এবং সৌরবিদ্যুৎ ক্ষেত্র নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে উৎসাহ দেখা যাচ্ছে তার কারণ মূলত তিনটি। প্রথমতঃ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কোন কাঁচামাল প্রয়োজন পড়ে না। ফলে কাঁচামালের যোগানের ওপর কোন প্রাতিষ্ঠানিক নির্ভরশীলতা বা অনিশ্চয়তা নেই। যদিও প্রাকৃতিক ও জলবায়ু জনিত অনিশ্চয়তা থাকলেও তার অনেকটারই আগাম পূর্বাভাস পাওয়া যায় প্রকল্প অঞ্চলের বিগত দু-তিন দশকের জলবায়ু সমীক্ষার মাধ্যমে। দ্বিতীয়তঃ এই বিদ্যুতকেন্দ্র গুলি স্থাপন করতে সময় লাগে কম। ফলে বিনিয়োগ করবার অল্পদিনের মধ্যেই ঘরে টাকা আসতে শুরু করে। আর তৃতীয়তঃ প্রযুক্তিগত জটিলতা ও রক্ষনাবেক্ষণের খরচ কম।

তাছাড়া পরিবেশ দূষণের কথা মাথায় রেখে ভারত সরকারের তরফেও ফটোভোল্টাইক প্যানেলের উৎপাদনে যা সৌরবিদ্যুৎ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় বিশেষ উৎসাহ ভাতা ও কর ছাড়ের ব্যবস্থা রয়েছে। গ্রামাঞ্চলে সৌরলন্ঠন ব্যবহারে রয়েছে বিশেষ ভর্তুকি। এমনকি ইদানীং শহরাঞ্চলে বিভিন্ন আবাসন / কম্যুনিটি বা ব্যক্তিগত বাড়িতে সৌর প্যানেল লাগানোতে বিভিন্ন রাজ্যের তরফে ভর্তুকি/ ছাড় দেওয়ার রেওয়াজ চালু হয়েছে।  

তবুও অচিরাচরিত শক্তির সবথেকে বড় সমালোচনা ছিল এর উৎসের ওপর যেহেতু কোন নিয়ন্ত্রণ নেই তাই দিনের মধ্যে বিদ্যুতের চাহিদা যখন সর্বোচ্চ থাকে তখন চাহিদা মত এখান থেকে বিদ্যুতের যোগান পাওয়া যায় না এবং তার জন্য আমাদেরকে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং জলাধার যুক্ত বৃহৎ জলবিদ্যুৎকেন্দ্র গুলির ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু গবেষক এবং প্রযুক্তিবিদরা সেই সমস্যা সমাধানের পথেও বেশ কিছুটা অগ্রসর হয়েছেন।

আপাতত দুটি পদ্ধতি ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা লাভ করছে। প্রথমটিতে বায়ু অথবা সৌরবিদ্যুৎ কে ব্যাটারির মাধ্যমে সংরক্ষণ করে প্রয়োজন মত চাহিদা অনুযায়ী ব্যবহারের একটি ক্ষেত্র ইদানীং তৈরি হয়েছে। আরও গবেষণার মাধ্যমে ব্যাটারি জীবনীশক্তি বা লাইফ বাড়িয়ে ও উৎপাদন খরচ কমিয়ে বাণিজ্যিক দিক দিয়ে আরও বেশি আকর্ষনীয় করে তোলার কাজ জারি রয়েছে। দ্বিতীয়ক্ষেত্রে দুই জলাধারযুক্ত জলবিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তুলে সৌরবিদ্যুৎ ও বায়ুবিদ্যুৎ ব্যবহার করে পাম্পের মাধমে নীচের জলাধারের জল ওপরের জলাধারে তুলে দিয়ে পরবর্তীতে সর্বোচ্চ চাহিদার সময় সেই জল ছেড়ে দিয়ে তার থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে চাহিদা মেটানোর পথও ইদানীং ব্যবহার করবার চিন্তাভাবনা হচ্ছে। আর এই উভয় ক্ষেত্রেই কোন ফসিল ফুয়েল ব্যবহার না হওয়ায় এগুলি অনেকটাই পরিবেশ দূষণমুক্ত। ফলে যত দিন যাবে দিনের সর্বোচ্চ চাহিদার সময় গুলিতে বিদ্যুৎ যোগানের জন্য এবং গ্রীড বিপর্যয় এড়াবার জন্য তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ওপর নির্ভরতা কমে আসবে।  

এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি ভারতে এই মুহুর্তে যে কটি হাতেগোনা পাম্প স্টোরেজ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু আছে তার একটি আছে আমাদের এই বাংলাতেই। পুরুলিয়া জেলার বাঘমুন্ডীতে। ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন প্রকল্পটি তৈরি হয়েছিল ২০০৭ সালে ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ইলেক্ট্রিসিটি ডিস্ট্রিবিউশন কর্পোরেশন লিমিটেড (WBSEDCL) এর আন্ডারে। এখানে জানিয়ে রাখি আমাদের প্রধানমন্ত্রী যখন মহামারীর সময় রাত নটায় নয় মিনিট আলো নিভিয়ে দিয়া জ্বালিয়ে গ্রিড বিপর্যয়ের সম্ভাবনাকে ডেকে এনেছিলেন সেই সময় এই বিদ্যুৎপ্রকল্পটি সময় মত বিদ্যুৎ যোগান দিয়ে সে যাত্রা আমাদের উদ্ধার করেছিল।  

কাজেই কয়লা নির্ভর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বায়ু ও সৌরবিদ্যুৎ এবং পাম্পস্টোরেজ প্রকল্পের মত দূষণমুক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষেত্রের ওপর জোর দিয়ে আগামী দিনে আত্মনির্ভরতার অনুসন্ধান অনেক বেশি সময়োপযোগী হত বলেই আমাদের মনে হয়েছে।

এমনকি দেউচা-পাঁচামি কয়লাখনি প্রকল্পের খবর চাউর হতেই পরিবেশ দূষণের কারণ দেখিয়ে আন্তর্জাতিক মহল এবং ইল্যান্ড ও জার্মানির মত দেশগুলি তাদের ভারতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতদের মাধ্যমে প্রকল্পের ব্যাপারে আপত্তি ও উষ্মা প্রকাশ করেছেন। এমতাবস্থায় কোন দক্ষ এবং অভিজ্ঞ আন্তর্জাতিক সংস্থাকে টেকনোলজি পার্টনার হিসেবে প্রকল্পের সাথে যুক্ত করতেও রাজ্য প্রশাসন নানাবিধ অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারেন বলে একাংশের ধারণা।    

জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া কি ঠিক মতন পদ্ধতি মেনে হচ্ছে! ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসন প্যাকেজ দিয়ে কি স্থানীয় আদিবাসী মানুষের মন জেতা যাচ্ছে!

আমরা আগেই আলোচনা করেছি এই প্রকল্পের জন্য মোট ১১,২২৩ একর জমি লাগবে যার মধ্যে সরকারী খাসজমি ২০০০ একর। কমবেশি ৫% জমি অর্থ্যাৎ ৫০০-৬০০ একর জমি হচ্ছে বনাঞ্চল। আর বাকিটা স্থানীয় অধিবাসীদের যার একটা বড় অংশ আদিবাসী। প্রায় ২১,০০০ মানুষের বাস্ত্যুচ্যুত বা কর্মচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে বিভিন্ন সংবাদসংস্থা সূত্রে খবর সরাসরি না হলেও এই খোলামুখ খনি প্রকল্পের প্রভাব পড়বে প্রায় ৫৩ টি জনপদের ৭০,০০০ মানুষের জীবনে। তার কিছু হয়তো ভালো আবার কিছু হয়ত খারাপ।

তাই ২০১৩ সালের জমি অধিগ্রহণ এবং পুনর্বাসন আইন মোতাবেক এমন প্রকল্পের জন্য সরকার যখন জনস্বার্থে জমি অধিগ্রহণ করবে তখন শুধু পরিবেশ নয় প্রকল্পের সামাজিক প্রভাব খতিয়ে দেখে তার পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট জনসমকক্ষে পেশ করা এবং এলাকার মানুষকে সে সম্পর্কে অবহিত করে গণশুনানি বা পাবলিক হিয়ারিং করা বাধ্যতামূলক। পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদদের সাথে পরামর্শ বা মতামত নেওয়াও আবশ্যিক। কিন্তু অভিযোগ সরকারের তরফে সেরকম কোন রিপোর্টও পেশ করা হয় নি এবং গণশুনানিও করা হয় নি। সরাসরি ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসন প্যাকেজ ঘোষণা করে জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করে দেওয়া হয়েছে।

একইভাবে এই প্রকল্প এলাকার মধ্যে যে বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল রয়েছে এই এলাকায় বসবাসকারী আদিবাসীদের জীবন-জীবিকা তার ওপর নির্ভরশীল। ২০০৬ সালে আইন পাশ করে আদিবাসীদের বনাঞ্চলে জল-জঙ্গল-জমির অধিকার দেওয়া হয়েছে। সেই আইন অনুযায়ী বনাঞ্চলে কোন শিল্পস্থাপন করতে হলে এবং আদিবাসীদের পুনর্বাসনের প্রসঙ্গ জড়িত থাকলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় গ্রামসভার মিটিং ডেকে ঐ প্রকল্পের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। এর পাশাপাশি শুধু প্রতিশ্রুতি দিলেই হয় না সরকারের তরফে লিখিতভাবে ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসন প্যাকেজ গ্রামসভাকে জানাতে হয় এবং সেই পুনর্বাসনের সমস্ত ব্যবস্থা সম্পুর্ণ না করা পর্যন্ত জমিঅধিগ্রহণ বা উচ্ছেদ করা যায় না। কিন্তু স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের অভিযোগ এসবের কিছুই করা হয় নি। বরঞ্চ পুলিশ প্রশাসনের তরফে ভয় দেখিয়ে চাপ সৃষ্টি করে প্রকল্পের জন্য মানুষকে জমি ছেড়ে দিতে রাজি করানোর চেষ্টা চলছে।

আর এরই প্রতিবাদে এলাকার আদিবাসীরা নিজেদের মধ্যে সংগঠিত হতে শুরু করেছেন। মিটিং-মিছিল হচ্ছে মাঝেমধ্যেই। রাজ্য বামফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ বেশ কয়েকবার গিয়েছেন এলাকা পরিদর্শনে। এনিয়ে শুরু হয়েছে স্থানীয় আদিবাসীদের সাথে ওখানকার পুলিশ -প্রশাসনের চাপানোউতর। টানাপোড়েন। ইতিমধ্যেই আদিবাসীদের সঙ্গে পুলিশের বেশ কয়েকটি বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের খবর এসেছে। খবর এসেছে শাসকদলের বাহিনীকে পিটিয়ে এলাকাছাড়া করবার মত খবরও। আবার প্রশাসনের তরফ থেকে দাবি করা হচ্ছে ইতিমধ্যেই ২১০ জন আদিবাসী কয়লাখনি প্রকল্পে জমি দিতে নাকি সম্মত হয়েছেন। ফলে আদিবাসীদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে কিছু বিভ্রান্তি। আর সেইজন্য এসব থেকে সরে এসে পুরো অধিগ্রহন পদ্ধতিটিকে স্বচ্ছ রাখবার জন্য আদিবাসীদের বেশ কয়েকটি সংগঠনের তরফে জানানো হয়েছে মহম্মদ বাজার ব্লকের এই আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাটিকে পঞ্চম তফসিলের আওতায় নিয়ে আসা হোক। এব্যাপারে সংশ্লিষ্ট জেলা শাসকের দপ্তরে গিয়ে কোভিড-বিধি মেনে ডেপুটেশানও দেওয়া হয়েছে।

এখানে আমরা যদি একটু ছোট্ট করে জেনে নিই সংবিধানের পঞ্চম তফসিল-টা ঠিক কি তাহলে পুরো ব্যপারটা বুঝতে সুবিধে হবে! এই পঞ্চম তফসিলে জম্মু কাশ্মীর এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের পাঁচটি রাজ্য যথা আসাম-ত্রিপুরা-মেঘালয়-মিজোরাম এবং অরুণাচল প্রদেশ বাদ দিয়ে বাকি রাজগুলির আদিবাসী জনজাতি ও উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল গুলির শাসণ ব্যবস্থার বিধান ও নিয়ন্ত্রনের স্বাধিকার রাজ্যের ট্রাইবাল অ্যাডভাইসরি কাউন্সিলের মাধ্যমে স্থানীয় গ্রামসভার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য যাতে ঐ সমস্ত প্রান্তিক মানুষদের জীবন-জীবিকা সামজিক রীতি-আচার সব কিছু যেন সুরক্ষিত থাকে।  

আর তাই প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকাটি যেহেতু আদিবাসী অধ্যুষিত দাবি মত পঞ্চম তফসিলের আওতায় এলে গ্রামসভার মিটিং ডেকে সর্বসম্মতিক্রমে প্রকল্পের স্বপক্ষে অথবা বিপক্ষে আদিবাসী সমাজ একত্রিত ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে এবং সেই সিদ্ধান্ত প্রশাসন মানতে আইনত বাধ্য থাকবে। প্রশাসনের তরফে বা শাসকদলের তরফে বিভ্রান্তিমূলক প্রচার চালিয়ে আদিবাসী সমাজকে ভাগ করে দেওয়া যাবে না।

আর এজন্যই আদিবাসী সংগঠন গুলি এই মুহুর্তে সরকারের দেওয়া ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসন প্যাকেজ নিয়ে কিছু ভাবতেই চাইছে না। তাদের বক্তব্য আগে গ্রামসভা ডেকে ঠিক হোক প্রকল্প করতে দেওয়া হবে কি না! যদি আদিবাসী সমাজ ঠিক করে খনিপ্রকল্পটি হবে তখন তারা প্যাকেজ নিয়ে ভাববে! 

আবার এই প্রকল্প এলাকার মধ্যেই দুবরাজপুর অঞ্চলের কিছু মানুষ জানিয়েছেন উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন পেলে তারা প্রকল্পের জন্য জমি দিতে রাজি আছেন। তবে প্রতিশ্রুত প্যাকেজটির বাস্তবায়নের সময়সীমা নিয়ে তাদের কিছু প্রশ্ন আছে। সে ব্যাপারে তারা প্রশাসনের সাথে কথা বলে বিশদে জেনে নিতে চায়। কারণ আমাদের দেশে এবং রাজ্যে সরকারের থেকে সময়মত ক্ষতিপূরণ না পাওয়ার উদাহরণও ভূরিভূরি। আর এটা পরিবারের রুটি-রুজির প্রশ্ন। তাই ভালোকরে জেনেবুঝে তবেই এগোতে চান তাঁরা।    

আপাতত এই হল পুরো প্রকল্পটি নিয়ে আমাদের ভাবনা এবং আপডেট। পরবর্তীতে যেমন যেমন খবর এবং তথ্য আমাদের হাতে আসবে সেইমত আমরা আপনাদের জানাতে থাকবো। এমনকি আমাদের প্রকাশিত কলামের কোন বিরুদ্ধ বস্তুনিষ্ঠ মতামত সামনে এলে তাও আমরা প্রকাশ করতে দ্বিধা করবো না। 

পরিশেষে জানিয়ে দিই, শিল্প স্থাপন অথবা উন্নয়ন নিয়ে আমরা কোন রাজনীতি বা দলাদলি চাই না। তাই দেউচা পাঁচামি প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ নিয়ে স্থানীয় আদিবাসীদের সাথে প্রশাসনের যে টানাপড়েন চলছে তাই নিয়ে “বাজার গরম করা” লেখা ছাপানো রাইজ অফ ভয়েসেস এর উদ্দেশ্য নয়। এমনকি আমরা এটাও জানিয়ে দিতে চাই শিল্প বা শিল্পপতি কারোর বিরুদ্ধেই আমাদের কোন লড়াই নেই যতক্ষণ পর্যন্ত আইন কানুন মেনে সবকিছু হচ্ছে! আমাদের কাজ যা সত্যি, তা আপনাদের সামনে তুলে ধরা। বিচারের দায়িত্ব আপনাদের। 

আপনারা লেখাটি পড়ে অবশ্যই আমাদের কমেন্টবক্সে কেমন লাগলো জানাতে ভুলবেন না। এমনকি আমাদের ভুল-ত্রুটি থাকলে ধরিয়ে দেবেন। আমরা সংশোধন করে নেব। আর আপনাদের ঘনিষ্ঠবৃত্তে লেখাটি ছড়িয়ে দিয়ে আমাদেরকে আরও বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌছাতে সাহায্য করবেন।     

ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস

তথ্যসূত্র

  1. https://economictimes.indiatimes.com/industry/indl-goods/svs/metals-mining/worlds-second-largest-coal-block-to-settle-displaced-family-first/articleshow/71084723.cms
  2. https://www.business-standard.com/article/economy-policy/foreign-consuls-concerned-about-deocha-pachami-coal-mining-project-121112300622_1.html
  3. https://www.telegraphindia.com/business/uk-and-germany-flag-concerns-about-deocha-pachami-coal-block/cid/1840297
  4. https://indianexpress.com/article/cities/kolkata/bengal-moves-on-mega-coal-block-7658016/
  5. https://www.livemint.com/Industry/bUUdfzniESlxCJ4f93Rt7J/West-Bengal-gets-Deocha-Pachami-coal-mine-extraction-may-be.html
  6. https://www.anandabazar.com/editorial/essays/coal-mine-of-deucha-panchami-is-a-vast-reserve-of-coal-but-mining-might-not-be-possible/cid/1316225
  7. https://www.thehindu.com/news/national/other-states/indias-largest-coal-mine-coming-up-at-birbhum-mamata/article7946612.ece
  8. https://scroll.in/article/1012012/photos-indias-largest-coal-mining-project-has-cast-a-pall-of-uncertainty-over-villages-in-bengal
  9. https://www.deccanherald.com/opinion/deocha-pachami-coal-mine-industry-displacement-and-cpim-tmc-role-reversal-1065125.html
  10. https://indianexpress.com/article/india/political-faultlines-at-ground-zero-of-coal-block-in-birbhum-6188358/
  11. https://thewire.in/rights/tribal-agitation-bengal-mining-deocha-pachami-mamata
  12. https://www.newsclick.in/deocha-pachami-coal-project-compensation-rehabilitation-land-losers-key-challenges-mamata
  13. https://economictimes.indiatimes.com/industry/indl-goods/svs/metals-mining/centre-allots-worlds-second-largest-coal-block-to-west-bengal/articleshow/71185329.cms?from=mdr
  14. https://xiaomi.dailyhunt.in/news/india/kannada/down+to+earth-epaper-dearth/deucha+pachami+mining+india+s+largest+coal+block+will+displace+21+000+in+bengal-newsid-n345688756?pgs=N&pgn=6&mode=wap&&nsk=home-updates-home
  15. https://www.anandabazar.com/west-bengal/mamata-bandopadhay-seeks-full-share-of-india-s-largest-coal-mine-deocha-pachami-in-birbhum-1.259615
  16. http://purbanchal.co/west-bangal/1989/?fbclid=IwAR2Jf6G3JSo1nJyVdVhfJ8iau9D5kxjk1cyy6sFCO2eyE4K97hti3NAyskw
  17. http://purbanchal.co/west-bangal/2035/?fbclid=IwAR0BgpMcUMAiJCDxxNcK2VmslRX3mSl71Ewy0xpi-vfMwjyuC7UxOlja2Sg
  18. http://purbanchal.co/west-bangal/2097/?fbclid=IwAR1mB1UhJjnr5myvWuus7LuPDVsZJ_ThzgAqBmOMNL-odrq1ZwgqQFUahgI
  19. http://purbanchal.co/west-bangal/2150/